অধিকৃত এলাকায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে রাশিয়া কতটুকু লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে খোদ রাশিয়ার ভেতরেই। রাশিয়ার ক্রমাগত আক্রমণের মুখেও এই যুদ্ধে ইউক্রেন বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে এবং রাশিয়া কর্তৃক অধিকৃত বেশ কিছু এলাকা সাম্প্রতিক সময়ে তারা পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই যুদ্ধে ইউক্রেনের শক্তির উৎস পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক অস্ত্র ও অর্থের জোগান, যা প্রকাশ্য। অন্যদিকে বলা চলে, রাশিয়া একা লড়ে যাচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের সেনাদের মনোবল নিয়েও কিছু নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, যদিও এগুলোকে পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক ছড়ানো গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়ার অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, যুদ্ধে প্রত্যাশিত ফল অর্জিত হওয়ার পরিবর্তে তারা তাদের অধিকৃত এলাকাগুলো ধরে রাখতে ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। মূলত এই ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করেই অধিকৃত এলাকাগুলোতে গণভোটের আয়োজন করেছে, যা চলমান রয়েছে। অধিকৃত এলাকা দোনেত্স্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসনে গত ২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গণভোট হয়েছে। এ ছাড়া খারকিভেও গণভোটের পরিকল্পনা করছে তারা। সর্বশেষ দিনে ভোটারদের সরাসরি উপস্থিতি নিশ্চিত করতে অনেক ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। রাশিয়া কর্তৃক এই সময়ে এ ধরনের গণভোটের আয়োজনের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই গণভোটের উদ্দেশ্য সবার কাছে পরিষ্কার অর্থাৎ এটি সবার জানা, এই পরিকল্পিত গণভোটের ফলাফল স্বাভাবিকভাবে রাশিয়ার পক্ষে না গেলেও এটিকে যেকোনো উপায়ে তাদের পক্ষেই নেওয়া হবে, যার অর্থ দাঁড়াবে অধিকৃত এলাকার মানুষ রাশিয়া ফেডারেশনের সঙ্গে থাকতে চায় এবং তাদের এই চাওয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা দেবেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী ইউক্রেনের ১৫ শতাংশ এলাকা রাশিয়ার এলাকা হিসেবে গণ্য হবে এবং এসব এলাকার মানুষের তথাকথিত নিরাপত্তার স্বার্থে আরো তীব্র মাত্রায় আক্রমণকে রাশিয়া এক ধরনের আন্তর্জাতিক বৈধতার আওতায় আনার চেষ্টা করবে।

ইউক্রেনের অধিকৃত এলাকাগুলোতে রাশিয়ার গণভোটকে নিঃসন্দেহে গত কিছুদিনে রাশিয়ার দখলে থাকা কিছু জায়গায় ইউক্রেনের পুনর্দখলের প্রেক্ষাপটে আগামী দিনগুলোতে সম্ভাব্য তীব্র আক্রমণ পরিচালনার সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করছে। গণভোটের আগে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বক্তব্য থেকেই বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়াকে রক্ষায় তাঁর হাতে যত উপায় রয়েছে, তার সব ব্যবহার করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন, যা বেশ উদ্বেগজনক। রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ স্পষ্ট ভাষায়ই বলেছেন, রাশিয়ার সীমানাভুক্ত করা অঞ্চলগুলো প্রতিরক্ষায় পরমাণু অস্ত্রও ব্যবহার করা হতে পারে। এরই মধ্যে পুতিন তিন লাখ সেনা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। রাশিয়া তাদের এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রণক্ষেত্র প্রতিরক্ষায় তাদের মোতায়েন করতে পারবে। এদিকে এই সেনা সমাবেশের প্রাক্কালে রাশিয়া তার  সেনাদের জন্য কঠিন বার্তা দিয়েছে। যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত সেনা সংগ্রহের এই সময়ে রাশিয়ায় সামরিক বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, আত্মসমর্পণ বা বিনা ছুটিতে কাজে অনুপস্থিত থাকা—এগুলো ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই গণভোটের মধ্য দিয়ে রাশিয়া কী অর্জন করতে চাচ্ছে এবং তা কতটুকু অর্জন করতে পারবে? এর উত্তর হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে নিকট অতীতের উদাহরণ রয়েছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার আগেও তারা এ ধরনের গণভোটের আয়োজন করেছিল এবং এর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল, যা এখনো উঠছে। সেদিক দিয়ে এটিকে তারা খুব একটা তোয়াক্কা করছে না। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজকের মতো সরাসরি সে সময় তাদের অবস্থানকে জানান দেয়নি, সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে গণভোট-উত্তর পরিস্থিতিতে অধিকৃত এলাকাগুলোকে রাশিয়ার ভেতর অন্তর্ভুক্তিসংক্রান্ত বিষয়টি যে পশ্চিমারা সহজে মেনে নেবে, সেটির নিশ্চয়তা নেই। এ ক্ষেত্রে ধারণা করা যায় যে ইউক্রেন বর্তমানে যেভাবে তাদের হারানো এলাকাগুলো রাশিয়ার দখল থেকে পশ্চিমাদের সহায়তায় মুক্ত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, সেটি অব্যাহত থাকবে। এখন এরপরের প্রশ্ন হচ্ছে—এমনটি হলে রাশিয়ার দিক থেকে কী করণীয় থাকবে? উত্তর হচ্ছে, পুতিন তা খুব স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁদের আত্মরক্ষা করার মতো সব ধরনের উপায় সঙ্গে রয়েছে এবং প্রয়োজনে তিনি তাঁর কাছে থাকা উপায়গুলোর সদ্ব্যবহার করবেন অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করবেন! সব কিছু যদি উল্লিখিত হিসাব অনুযায়ী চলে, তাহলে অনুমান করতেই ভয় হয়, কী এক কঠিন পরিস্থিতি সামনে অপেক্ষা করছে! এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি পুতিনের হুমকির বিষয়টি হালকা করে দেখছেন না এবং তিনি পশ্চিমা গণমাধ্যমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘এটি কোনো ধাপ্পাবাজি নয়। ’

পুতিন সম্পর্কে সারা বিশ্বে যে ধারণাগুলো চর্চিত রয়েছে তা হচ্ছে, তাঁকে আসলে বুঝে ওঠা খুব কঠিন। তিনি না বুঝে ঝোঁকের মাথায় কোনো কাজ করে বসেন না, তিনি যেকোনো উপায়েই নিজেকে বিজয়ী করতে চান এবং তিনি তাঁর প্রয়োজনে কঠিন পন্থাগুলোকে অনুসরণ করতে কোনো দ্বিধা করেন না। এর অসংখ্য উদাহরণ আমরা তাঁর শাসনকালে দেখেছি। এর আগেও তাঁকে এ কথা বলতে শোনা গেছে যে রাশিয়াই যদি না থাকে, তাহলে বিশ্বের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি আসলে এক ধরনের মরণখেলায় মেতেছেন।

এখন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর কেবল ইউক্রেন নয়, পুরো বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তবে এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে এই মুহূর্তে ইউক্রেনের বাইরে বিশ্বের অপরাপর অঞ্চলের তুলনায় ইউরোপের নিরাপত্তা অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা জানি, গত মার্চ মাসে রাশিয়া ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়ার দখল নিয়েছে এবং ইউক্রেনের কারিগরি লোকদের দিয়ে এটি পরিচালনা করাচ্ছে। এরই মধ্যে এই কেন্দ্রটিকে লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণে বিদ্যুৎ সংযোগে বিঘ্ন ঘটেছে এবং পুরো ইউক্রেনে এর প্রভাব পড়েছে। পরে অবশ্য রাশিয়া এর দায় স্বীকার না করে ইউক্রেনই রাশিয়ার বাহিনীকে রুখতে এই হামলা পরিচালনা করেছে বলে জানায়। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এই কেন্দ্রে যদি বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে ইউরোপে এর তেজস্ক্রিয়তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ইয়েল স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক পল ব্র্যাকেন বলেন, ‘গোলাবর্ষণে পারমাণবিক চুল্লির দেয়াল ফেটে বিশাল এলাকায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারে। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। জাপোরিঝিয়ার নিরাপত্তায় ব্যর্থ হলে হাজার হাজার লোক মারা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ’ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, মস্কো ইউরোপকে পারমাণবিক বিপর্যয়ের ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছে।

রাশিয়া এমন সময়ে এই চারটি অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করেছে, যখন অঞ্চলগুলো পুরোপুরি রাশিয়ার দখলে নেই আবার দখলে থাকা অঞ্চলগুলোর কিছু এলাকা ইউক্রেন পুনরায় তাদের দখলে নিয়ে গেছে। খোদ জাপোরিঝিয়ার রাজধানীই বর্তমানে ইউক্রেনের দখলে। এখানে তারা কিভাবে গণভোট করবে সেটি স্পষ্ট নয়। আবার পূর্ব দিকের দোনেেস্কর মাত্র ৬০ শতাংশ এলাকা এখন রাশিয়ার দখলে এবং সেখানে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সঙ্গে রুশ বাহিনীর তীব্র লড়াই চলছে। লুহানস্কের বেশির ভাগ এলাকা রাশিয়ার দখলে থাকলেও সেখানেও তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে।

সার্বিক দৃষ্টিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের শুরুতেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক যেমন আস্থা ও বৈধতার সংকটে ভুগছিল, বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনায় এই আস্থার জায়গাটি আরো নড়বড়ে হয়ে পড়ায় তারা অনেকটা নিজ থেকেই নিজেদের যেন ক্রমেই কোণঠাসা করে ফেলছে। এর মূল কারণ অবশ্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পুতিন যেকোনো উপায়েই হোক নিজেকে বিজয়ী দেখতে চান। তাঁর গণভোটের আয়োজন নিঃসন্দেহে তাঁকেই বিজয়ী করবে। কারণ এর আগে যখন ক্রিমিয়া প্রশ্নে এ ধরনের গণভোটের আয়োজন করা হয়, তখন মস্কো দাবি করেছিল যে ৯৬.৭ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে, বাস্তবে যা ছিল ৩০ শতাংশেরও কম। এর ফলাফল নিয়েও তখন যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।

সব শেষে রাশিয়া গণভোটের মধ্য দিয়ে অধিকৃত অঞ্চলগুলোকে রুশ অঞ্চলে পরিণত করে সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে যাওয়া ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতর যুদ্ধের বার্তাকে যেভাবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটি আসলে গায়ের জোরে। আন্তর্জাতিক আইন এবং বিধি-বিধান কেবল আক্রমণকে বৈধতা দেওয়ার রাশিয়ার এ ধরনের দাবিকে সমর্থন করে না। ইউক্রেন তাদের অবস্থান এরই মধ্যে স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে অধিকৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা তারা চালিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন যে রাশিয়ার দখলকৃত ভূমিতে ইউক্রেনীয়দের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। বোঝা যাচ্ছে, দুই পক্ষই তাদের অবস্থানে অনড়। এ ক্ষেত্রে অধিকৃত এলাকাগুলোতে গণভোট আসলে তীব্র ও দীর্ঘায়িত যুদ্ধকেই ইঙ্গিত করছে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ