অকাল মৃত্যুর মিছিল বন্ধে পদক্ষেপ জরুরি

সিল্কসিটিনিউজ মতামত ডেস্ক:

তামাকজাত পণ্য মানুষের দেহের যে ক্ষতি করে নিঃসন্দেহে তা কেউ অস্বীকার করবে না। এক একটি স্লোগান নিয়ে প্রতিবছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় তামাকমুক্ত দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য (৩১ মে এর পরিবর্তে পালিত হচ্ছে ২০ জুন) ‘তামাকে হয় ফুসফুসে ক্ষয় : সুস্বাস্থ্য কাম্য, তামাক নয়’। প্রতিপাদ্যটি নিরেট সত্য।

কেননা- ফুসফুস মানুষের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যার ক্ষয় মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই নয়। তামাকের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি), যক্ষ্মা, অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানা ধরনের শ্বাসকষ্টের রোগ হয়।

প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে অন্তত দেড় লাখেরও বেশি মানুষের অকাল মৃত্যুরোধে কার্যকর জরুরি কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে তেমন পড়ছে না বললেই চলে। অকাল মৃত্যুর এই দীর্ঘ মিছিল বন্ধে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন- এমনটাই আমাদের আশা।

আমরা যদি বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস নিয়ে একটু কথা বলতে চাই তাহলে প্রথমেই যেটি আসে সেটি হলো- বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ৩১ মে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৭ সালে প্রথম ৭ এপ্রিল, ১৯৮৮ সালে বিশ্ব ধূমপানবিহীন দিবস পালনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালেই ঠিক করা হয় প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হবে।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্ষিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষণীয় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো বিষয়টি নজরে এনেছে যে, ধূমপানের ক্ষতির পাশাপাশি অন্য সব প্রকার তামাকদ্রব্য সেবন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই শুধু ধূমপান থেকে নয়; এই দিনে সব প্রকার তামাকদ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকার কথা বলা হচ্ছে। ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাকের দুটি প্রধান ধরন আজ মানুষের মধ্যে রোগ এবং মৃত্যুর বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি প্রচলিত হয়েছে। এছাড়াও দিবসটির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং স্বাস্থ্যের নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু আমরা কী দেখছি? দেশে তামাক ও তামাকজাতদ্রব্য গ্রহণের কারণে প্রতিদিন ৪৪১ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে।

সেই হিসেবে বছরে তামাকজনিত রোগে মারা যাচ্ছে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। ‘গ্লোবাল এ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে-গ্যাট্স’ এর ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ৩৫% অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে ধূমপায়ী ১৮% (১ কোটি ৯২ লাখ) এব ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২০.৬% (২ কোটি ২০ লাখ)। শহরের জনগোষ্ঠির (২৯.৯%) তুলনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠির (৩৭.১%) মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার অনেক বেশি।

বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তামাক আসক্তি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২% (সূত্র: এঝঐঝ, ২০১৪)।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয় ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের চেয়ে তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।

তাহলে বাস্তবতা আসলে কী দাঁড়াচ্ছে? তামাকের কারণে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। বছরে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ধূমপায়ীদের ক্ষতিকর নিকোটিনের ধোঁয়ায় অধূমপায়ীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথযাত্রী হচ্ছে। ধূমপানের কারণে এমন স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য প্রত্যেক বিবেকবান মানুষকেই নাড়া দেয়।

তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে দেদারছে তাদের অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছে। ধূমপায়ীরাও আইন লঙ্ঘন করে যত্রতত্র ধূমপান করে দেশের নির্মল বায়ু ক্ষতিকর নিকোটিনে ভরিয়ে দিচ্ছে। এতে করে সরকারি অফিস আদালত, বাস স্ট্যান্ড, রেলভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি নিজ বাড়িসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ধূমপায়ীদের ধোঁয়ায় অধূমপায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাই কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের দাবি- দেশের মানুষের এমন সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। দেশে তামাক চাষ বন্ধ করে বিকল্প চাষের দিকে তামাক চাষিদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ জন্য দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হবে।

তামাকের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অবৈধ ব্যবসা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এই কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে কৌশলে অবৈধ প্রচারণায় পুরো দেশ সয়লাব করে দিয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ চোখে পড়েনি। দেশের অনেক জনপ্রতিনিধি তামাকের বহুজাতিক এই কোম্পানিগুলোর পক্ষে সাফাই গেয়ে তাদের তাদের অবৈধ ব্যবসার পথ বহুগুণে প্রশস্থ করে দিয়েছে।
এভাবে তামাকের আগ্রাসন চলতে থাকলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে সুন্দর ও সুস্থ মস্তিস্কের ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরিতে সঙ্কট দেখা দিবে। সম্ভাবনাময় উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাঝে পড়তে পারে উচু দেয়াল। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছেন তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। অকাল মৃত্যুর মিছিলের সারি দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘতর হবে। এই তামাকের কারণে দেশে মাদকের ভয়াবহতা আরও বাড়বে।

কাজেই তামাকের আগ্রাসন থেকে দেশ তথা দেশের প্রজাদের মুক্ত করার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এখনি নিতে হবে। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তামাকের উৎপাদন বন্ধ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অধিক মুনাফা লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে দেশের মানুষগুলোকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিন। উচ্চহারে তামাকপণ্যের দাম ও কর বৃদ্ধি করে তা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। সর্বপরি তামাকের আগ্রাসন বন্ধ করে প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দ্রত বাস্তবায়ন হোক এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজ।