টানা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে রুশ আগ্রাসন বন্ধের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এবং এই পরিস্থিতিতে সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাতের শঙ্কাও অনেকে প্রকাশ করছেন।
এই অবস্থায় রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সম্ভাব্য সংঘর্ষ নিয়ে পশ্চিমাদের হুংকার দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়া-ন্যাটো সংঘর্ষ হলে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে থাকবে বিশ্ব।
সোমবার (১৮ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের অর্থ হচ্ছে এই গ্রহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে এক ধাপ দূরে থাকবে বলে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সোমবার পশ্চিমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, এই ধরনের কোনও দৃশ্য খুব কম লোকই দেখতে চায়।
রাশিয়ার আগ্রাসনের জেরে দুই বছর আগে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ১৯৬২ সালের কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর থেকে পশ্চিমের সাথে মস্কোর সম্পর্কের গভীরতম সংকটের সূচনা করেছে। এরপর থেকে পুতিন প্রায়ই পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে এসেছেন। যদিও তিনি বলেছেন, তিনি কখনোই ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভব করেননি।
এছাড়া পুতিন বেশ কয়েকবার সতর্ক করে বলেছেন, পশ্চিমারা ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য সৈন্য পাঠালে সেটি পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করবে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গত মাসে বলেছিলেন, তিনি ভবিষ্যতে ইউক্রেনে স্থল সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারছেন না। ম্যাক্রোঁর এই বক্তব্য থেকে অনেক পশ্চিমা দেশই নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। তবে অন্যরা, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ফরাসি প্রেসিডেন্টের কথার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে।
ম্যাক্রোঁর মন্তব্য এবং রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সংঘর্ষের ঝুঁকি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে রয়টার্স জানতে চাইলে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বে সবকিছুই সম্ভব।’
গত ১৫-১৭ মার্চ রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ছয় বছরের মেয়াদের জন্য পুনরায় পুতিনই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল। প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এবারের নির্বাচনে প্রায় ৮৭ শতাংশ ভোট পড়েছে তার পক্ষে।
সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়ের পর পুতিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা সবার কাছে পরিষ্কার, এটি (রাশিয়া-ন্যাটো সংঘর্ষ) হবে এমন কিছু যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে এক ধাপ দূরে। আমার মনে হয় খুব কমই কেউ এতে আগ্রহী হবে।’
পুতিন আরও বলেছেন, ন্যাটোর সামরিক কর্মীরা ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে উপস্থিত রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজি এবং ফরাসি উভয় ভাষাতেই কথা বলা হচ্ছে বলে রাশিয়া দেখতে পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘এতে ভালো কিছু নেই, প্রথমত তাদের জন্য, কারণ তারা সেখানে প্রচুর সংখ্যায় মারা যাচ্ছে।’
গত ১৫-১৭ মার্চের নির্বাচনের আগে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটি সীমান্ত অঞ্চলে গোলাবর্ষণ করে এবং এমনকি রাশিয়ার সীমানা ভেদ করে রুশ ভূখণ্ডের ভেতরে হামলার চেষ্টা করার জন্য প্রক্সি যোদ্ধাদেরও ব্যবহার করেছে।
এমন অবস্থায় ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চল দখলে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়তা মনে করেন কিনা জানতে চাইলে পুতিন বলেন, হামলা অব্যাহত থাকলে রাশিয়ার ভূখণ্ড রক্ষার জন্য ইউক্রেনের ভূখণ্ডের বাইরে একটি বাফার জোন তৈরি করবে রাশিয়া।
পুতিন বলেছেন, ‘আজকে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার কথা মাথায় রেখে আমি (এই ধারণাটি) বাদ দিচ্ছি না, আমরা যখন উপযুক্ত মনে করব তখন কিয়েভের শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে একটি নির্দিষ্ট ‘স্যানিটারি জোন’ তৈরি করতে বাধ্য হবো।’
অবশ্য রাশিয়ার এই প্রেসিডেন্ট এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, রাশিয়ার ভূখণ্ডে বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার জন্য এই ধরনের একটি অঞ্চল যথেষ্ট বড় হতে পারে।
পুতিন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে লাখ লাখ সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। আর সেটি একদিকে ইউক্রেনীয় বাহিনী এবং অন্যদিকে রাশিয়াপন্থি ইউক্রেনীয় এবং রাশিয়ান প্রক্সিদের মধ্যে পূর্ব ইউক্রেনে আট বছরের সংঘর্ষের পরে দেশটিতে পূর্ণ-মাত্রায় যুদ্ধের সূত্রপাত করে।
পুতিন বলেন, তিনি চান ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের যুদ্ধকে আরও বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা বন্ধ করে শান্তি খোঁজার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। তার ভাষায়, ‘মনে হচ্ছে ফ্রান্স এক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। এখনও সব কিছু হারিয়ে যায়নি।’
পুতিন বলেন, ‘আমি এটা বারবার বলেছি এবং আমি আবারও বলব। আমরা শান্তি আলোচনার পক্ষে।’
তার ভাষায়, ‘যদি তারা সত্যিই, গুরুত্ব সহকারে দীর্ঘমেয়াদে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিপূর্ণ, ভালো প্রতিবেশী-সুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় এবং তাহলে তারা যেন পুনরায় অস্ত্রসজ্জার জন্য কেবল দেড় থেকে দুই বছরের বিরতি না নেয়।’