সাজিদ হোসেন ও গোলাম রববিল, রাবি:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান চর্চার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্রে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। দেশি-বিদেশি বই, শিক্ষকদের গবেষণাপত্র, জার্নাল, সংবাদপত্র ও সাময়িকীসহ প্রায় আড়াই লক্ষেরও বেশি সংগ্রহের সমাহার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই গ্রন্থাগার। তবে এই বিপুল সংখ্যক জ্ঞান ভাণ্ডারের লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার অতি নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতিদিন গ্রন্থাগারে পড়াশোনার জন্য যাতায়াত করেন গড়ে মাত্র ১০০ জন।
রাবির সিনিয়র অধ্যাপকদের একাংশ বলছেন, গত এক দশকে লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার উদ্বেগজনক। শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে যাওয়ায় ফলে লাইব্রেরি বিমুখ হয়ে পড়ছেন তারা। এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, লাইব্রেরিতে তাদের প্রয়োজনীয় বই পাওয়া যায় না। বই খোঁজা ও ইস্যু করতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। ডিজিটাল কোনো সুবিধা লাইব্রেরিতে নেই। সেই সাথে গ্রন্থাগারের নিচের সাধারণ পাঠকক্ষে রয়েছে আসন সংকট। ভোর থেকেই সিট ধরার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের। সিট না পেয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকেই ফিরে যেতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসে লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিল খুবই নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর তুলনায় জানুয়ারি মাসে লাইব্রেরিতে উপস্থিতির হার ছিল শ’খানিক। অন্যান্য মাসেরও একই চিত্র। এদিকে গ্রন্থাগারে প্রয়োজনীয় বই খোঁজার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে মাত্র একটি কম্পিউটার। ফলে বাধ্য হয়ে বুক শেলফ থেকেই প্রয়োজনীয় বই খুঁজতে হয় শিক্ষার্থীদের। আর সেই বই নিজের কাছে সংগ্রহ করার প্রয়োজন হলে সেই মান্ধাতা আমলের সনাতন পদ্ধতিতেই ইস্যু করতে হয়।
ডিজিটাল সুবিধা না থাকার পাশাপাশি নেই কোনো ই-লাইব্রেরি। গ্রন্থাগারের অনেক দুষ্প্রাপ্য বইয়ের নেই কোনো পিডিএফ সংস্করণ। ফলে শিক্ষার্থীরা চাইলেও বইগুলো পড়তে পারছেন না। গ্রন্থাগারের কিছু কিছু কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও সাধারণ পাঠকক্ষগুলোতে চলে বড় বড় বৈদ্যুতিক ফ্যান। ফ্যানের শব্দে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পাঠে মনোনিবেশ করতে পারেন না। এদিকে গ্রন্থাগারের রিডিংরুমেও রয়েছে আসন সংকট।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব বলেন, অনেক পুরোনো বই থাকলেও সেগুলোর নতুন সংস্করণ নেই। বইগুলো পড়ার জন্য অনুপযোগী হয়ে পরেছে। বিষয় ভিত্তিক সিলেবাসের সঙ্গে পুরোনো বইয়ের মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া অ্যাসাইনমেন্ট অর্থাৎ বিভাগের পড়াশোনা সংশ্লিষ্ট বই পাওয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীদের এখন মূল লক্ষ্যই হচ্ছে চাকরি করা। কেউ আলোকিত মানুষ হতে চায় না। বর্তমানে চাকরির পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। অনেক কম্পিটিশন পেরোতে হয়। কিন্তু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সাথে চাকরির পড়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ করার আগেই চাকরির প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ফলে তারা গ্রন্থাগার বিমুখ হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই লাইব্রেরিতে নতুন নতুন বই সংযোজনের চেষ্টা করছি। তবে দীর্ঘদিন গ্রন্থাগারে নতুন বই সংযোজন হয়নি।
লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থী না আসার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সময়ে ছোটবেলা থেকেই লাইব্রেরিতে যেতাম। লাইব্রেরিতেই পড়াশোনা করতাম। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় কখনো লাইব্রেরি যায়নি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাদেরকে লাইব্রেরি মুখি করা কঠিন।
উপ-উপাচার্য সুলতান উল ইসলাম বলেন, পাঠ্যবইয়ের কোনো ম্যাটেরিয়াল তাদের খুজতে হচ্ছে না, হাতের কাছে বিভিন্ন ফটোকপির দোকানে নোটশিট আকারে পেয়ে যাচ্ছে। বইয়ের সঙ্গে তাদের সমপর্কের ছেদ ঘটেছে। এছাড়া ক্লাসের পড়াশোনা, চাকরির পড়াশোনার পেছনে তারা ছুটছে। এর বাইরের জ্ঞানের সঙ্গে তাদের সমপর্ক ছেদ হয়েছে। আমরা লাইব্ররির আধুনিকায়ন নিয়ে কাজ করছি।
জি/আর