দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। মঙ্গলবার শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৫৪ জন, সোমবার এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮০৯ জন এবং রোববার ২ হাজার ১৭২ জন। নতুন শনাক্তদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে একশ থেকে দেড়শজন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ইতোমধ্যে রাজধানীর কোভিড হাসপাতালগুলোর আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা প্রায় শেষ। সাধারণ শয্যার সংখ্যাও পূর্ণ হতে চলেছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ১১৮ জন রোগী বেশি ভর্তি আছেন। এ হারে রোগী বাড়লে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে কোভিড ডেডিকেটেড সব হাসপাতালের শয্য পূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর শয্যার তুলনায় রোগী বাড়তে থাকবে। সেই পরিস্থিতি হওয়ার আগেই দ্রুত হাসপাতাল শয্যা বৃদ্ধির প্রস্তুতি নিতে হবে। তৈরি রাখতে হবে ফিল্ড হাসপাতাল। এমনকি বেসরকারি পর্যায়ের সব আইসিইউ শয্যা সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯ কোভিড হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ২ হাজার ৩৮১টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১ হাজার ৭৪৫ জন এবং ফাঁকা আছে ৬৩৬টি। এসব হাসপাতালে ১০৩টি আইসিইউ শয্যার ৯২টিতে রোগী ভর্তি আছেন। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট শয্যা রয়েছে ৩ হাজার ৩২১টি এর মধ্যে রোগী আছেন ২ হাজার ২৩৩ জন। ফাঁকা শয্যার সংখ্যা ১ হাজার ৮৮টি। কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত ১১ বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ১৬৪টি এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১১৮ জন। সব মিলে সারা দেশে কোভিড রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ১০ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৯৫৯ রোগী ভর্তি আছেন। এছাড়া সারা দেশে আইসিইউ শয্যা আছে ৫৪৯টি। এর মধ্যে ৩০৬ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অধিদপ্তর আরও জানায়, রোববার রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ছিল ২ হাজার ৮২ জন, সোমবার এটি বেড়ে হয় ২ হাজার ১৫৮ জন এবং মঙ্গলবার এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২৩৩ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুতগতিতে করোনা রোগী বাড়ছে। এদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে স্বল্প সময়ে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করতে হবে। তারা বলেন, নতুন স্থাপনা না করেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। কুর্মিটোলা হাসপাতালের ফাঁকা স্থানে আরও প্রায় একশ এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ তলার কেবিন ব্লকে কমপক্ষে ৭০টি শয্যা বাড়ানো সম্ভব। ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি না হলে রোগী সামলানো কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৫৪ জন। এর আগে গত বছরের ১৬ জুলাই এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়। সেদিন ৩ হাজার ৭৩৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় ২৬ হাজার ৩৫৭টি। অ্যান্টিজেনসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৫ হাজার ৯৫৪টি। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর আগে সোমবার সংক্রমণের হার ছিল ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং রোববার ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫১ শতাংশ। গণিতজ্ঞদের মতে, রোগী জ্যামিতিক বা গাণিতিক হারে বাড়ছে না। তবে গণিতের ভাষায় একে বৃদ্ধির উল্লম্ফন বলা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে সামনে বড় ক্রাইসিস সৃষ্টি হতে পারে। সেটি এড়াতে হলে চারটি বিষয় অবশ্যই মানতে হবে। ১. অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ২. হাত ধোয়ার অভ্যাস বজায় রাখতে হবে ৩. শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে এবং ৪. টিকা নিতে হবে। এর পাশাপাশি অধিদপ্তর থেকে যে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল সেটি বাস্তবায়নে সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। যেসব হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা বন্ধ করা হয়েছিল সেগুলো পুনরায় চালু করতে হবে। প্রয়োজনে আরও নতুন নতুন হাসপাতালে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, হাসপাতালের শয্যা বাড়িয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ও সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, এবারের করোনার যে ভাইরাস সংক্রমণ ছড়াচ্ছে সেটি বেশি শক্তিশালী। তাই এবারে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে যে হাসপাতালগুলো বন্ধ করা হয়েছিল সেগুলো চালু করলেই হবে না। শয্যা সংখ্যাও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি একাধিক ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে হবে। জটিল রোগীদের চিকিৎসার জন্য বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যেসব আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা রয়েছে সেগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে।
এদিকে করোনা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় রাজধানীর পাঁচটি সরকারি হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানকে কোভিড চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সোমবার রাতে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-১ শাখার উপসচিব ড. বিলকিস বেগম স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- লালকুঠি হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ও ডিএনসিসি করোনা আইসোলেশন সেন্টার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণের যে ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে সেটি সহজে নিয়ন্ত্রিত হবে এমনটি মনে করার কারণ নেই। তাই হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আইসিইউ, হাইফ্লো নেজাল কেনোলা ও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সরকারের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে আমি নিজেই ডিএনসিসি মার্কেট পরিদর্শন করেছি। সেখানে ১ হাজার ৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারসহ ৫০ শয্যার আইসিইউ শয্যা স্থাপন করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ মার্কেট সিটি করপোরেশনের, বর্তমানের ব্যবহার করছে আর্মড ফোর্সেস ডিপার্টমেন্ট আর হাসপাতাল চালাতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। তাছাড়া রোগীদের বাথরুম, লেট্রিনসহ বেশকিছু অবকাঠামোগত কাজও সম্পন্ন করতে হবে। বাকি চারটি হাসপাতালের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ওই হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের চিকিৎসা সম্পন্ন করে বাড়ি পাঠাতে হবে। তারপর কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় আরও জনবল (চিকিৎসক, নার্স) পদায়ন করতে হবে। সব মিলিয়ে কিছুটা সময় লাগবে।
সুত্রঃ যুগান্তর