শাহিনুল আশিক:
চাঁপাইয়ের পরে আম উৎপাদনে রাজশাহীর অবস্থান। দুই জেলার আম সারাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। তবে নেই আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা। ফলে প্রতিবছরই নষ্ট হচ্ছে, লাখ লাখ টাকার আম। এমন অবস্থায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াও আম উৎপাদনে আরও যত্নশীল হতে হবে চাষী ও ব্যবসায়ীদের বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্র বলছেন- প্রতিবছর শুধু কৃষক ও এলাকা ভিত্তিক উৎপাদিত ৩০ শতাংশ আম নষ্ট হয়। সেই সঙ্গে সংরক্ষণের অভাবে প্রায় ১০ শতাংশ ধরা গেলে দাঁড়ায় ৪০ শতাংশ। প্রতিবছর অবহেলাজনিত কারণে আমের ৪০ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে-সংরক্ষণের জন্য পরীক্ষামূলক রাজশাহী বিভাগে দুইটি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন হতে যাচ্ছে। যার একটি রাজশাহীর শিবপুরহাট ও অপরটি নাটোরের আহম্মদপুরে স্থাপিত হবে। দুই স্টোরেজে রাখা যাবে ৮ মেট্রিক টন আম।
সরেজমিনে পুঠিয়ার বানেশ্বরহাটের জমজমাট আম কেনা-বেচার চিত্র দেখা গেছে। উত্তরের দ্বিতীয় বৃহৎ আমের এই হাট থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ ট্রাক আম যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। প্রতি ট্রাকে গড়ে ১৩ টন করে আম ধরা হলে দাঁড়ায় ২৬০ টন। সপ্তাখানেক পরে আরও বাড়বে বলে জানান হাটের ইজারাদার ওসমান আলী।
তিনি বলেন- ‘জমজমাট আমের ব্যবসা চলবে প্রায় আড়াই মাস। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তুলনামূলক ব্যবসায়ী কম আসছে হাটে। তারা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রতিনিধির মাধ্যমে আম কিনেছেন। ২০১৯ সালের সেই সময়ের (মৌসুমের শুরুতে) তুলনায় এই বছর কম আম কেনা-বেচা হচ্ছে হাটে।’
হাট ঘুরে দেখা গেছে- গোপালভোগ প্রকার ভেদে খুচরায় বিক্রি হয়েছে- ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে। একই আম পাইকারে প্রকার ভেদে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা মণ দরে। এছাড়া খিরশাপাত খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা দরে। পাইকারে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। তবে এই অঞ্চলে আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই বলে জানান বাঘা চাষি সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, তিন বছর থেকে তারা ইউরোপে আম পাঠাচ্ছেন। ট্রাকে আম বোঝাই দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে প্যাকেজিং হাউসে রাখা হচ্ছে। রাজশাহীতে প্যাকেজিং হাউস না থাকায় নষ্ট হয় আম।
বিদেশে আম রফতানির বিষয়ে বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান জানান, আমের ‘সর্টিং ও গ্রেডিং’ করতে হয়। আমের গায়ে কোনো দাগ থাকা চলে না। এ জন্য ফ্রুট ব্যাগিং করতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ বোঁটাও আমের সঙ্গে রেখে কাঁচি দিয়ে কেটে নিতে হয়। এসব নিশ্চিত করে কৃষি বিভাগ থেকে প্রত্যয়ণপত্র নিতে হয়।
তিনি আরও জানান, রাজশাহী থেকে আম নিয়ে যাওয়ার পর ঢাকার সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউসে আমগুলো ‘হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ করা হয়। তারপর সেখানে ‘কোয়ারেন্টিন পেস্ট’ করাতে হয়। সে সময় আমে কোনো লালমাছির ডিম বা লার্ভা যদি একটিতেও পাওয়া যায়, তাহলে আমের গোটা চালানই বাতিল করা হয়। সেই জায়গা থেকে আমচাষি ও ব্যবসায়ীকে সচেতন হতে হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কেজেএম আবদুল আউয়াল জানান, ২ লাখ ১৪ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়েছে। এই অঞ্চলে বেশি লক্ষণভোগ আম উৎপাদন হয়। এই আমের দাম কম। সেই হিসেবে ৪০ টাকা কেজি ধরা হলে এবার ৮৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার আম উৎপাদন হয়েছে।
তিনি আরও জানান, পরীক্ষামূলক সংরক্ষণের জন্য রাজশাহী বিভাগের দুইটি জেলায় কোল্ড স্টোরেজ করা হচ্ছে। যার একটি রাজশাহীর শিবপুরহাট ও অপরটি নটোরের আহম্মদপুরে। সেখানে ৪ মেট্রিকটন করে আম সংরক্ষণ সম্ভব হবে। পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক হলে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
করোনা ও লকডাউনে আম বেচাকেনার প্রভাব সম্পর্কে বানেশ্বর হাটের ব্যবসায়ীরা জানান- করোনা ও লকডাউন দুই মেলে ক্রেতার সংখ্যা অন্য বছেরের তুলনায় কিছুটা কম। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি রয়েছেন। তারা আম কিনছেন, সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে।
ব্যবসায়ী রাজিবুল ইসলাম জানান- তিনি ঢাকা থেকে আম কিনতে এসেছেন। তার ঢাকায় আমের আড়ৎ রয়েছে। যদিও রাজশাহীতে তার ব্যবসায়িক প্রতিনিধি আছে। তিনি আম কিনে পাঠান। তবে সপ্তায় এক বার আসেন তিনি।
তিনি আরও জানান, আম বিক্রি খুব একটা ভালো না। এখন বেশির ভাগ মানুষ মোবাইল ফোন বা অনলাইনে অর্ডার করছেন। এর ফলে তাদের ব্যবসা কমেছে। তবে যে ক্রেতারা আম দেখে, খেয়ে কিনবেন তারা দোকানেই আসেন। আর রাজশাহীর আম অনেক সুস্বাদু।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মনিরুজ্জামান জানান, করোনা ও লকডাউনের ফলে আম বিক্রিতে কিছুটা প্রভাব পড়ছে। রাজশাহী থেকে আম পাঠাতে না পারলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন চালু করেছেন।
স/আ