সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
ঝুঁকিমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার কথা বলে রাজধানীর সড়ক থেকে এনালগ বিজ্ঞাপন বোর্ড অপসারণ করেছিল দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু এখন নিজেরাই আবার সে নিয়ম ভাঙছে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডিজিটাল এলইডি বিজ্ঞাপন বোর্ড লাগিয়ে সড়কগুলোতে পেতেছে নতুন করে মরণ ফাঁদ। সন্ধ্যা হলেই শত শত এলইডি বিলবোর্ডের আলো-আধাঁরের বিচ্ছুরণে সড়কে যানবাহন চলাচলই কষ্টকর। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার শঙ্কা। বিলবোর্ডের কারণে গাড়ি চালকরা হচ্ছেন দিকভ্রান্ত। নগর পরিকল্পনাবিদ, গাড়ি চালক ও সাধারণ মানুষের এসব অভিযোগ আমলেই নিচ্ছেন না করপোরেশনের কর্মকর্তারা। উল্টো তাদের দাবি, এলইডি বিলবোর্ড রাজধানীর সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।
শুধু তাই নয়, সিটি করপোরেশন নিজেদের তৈরি নীতিমালা নিজেরাই ভেঙেছেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে তার এলাকায় যে ৫১১টি এলইডি বোর্ড লাগিয়েছে, তা তাদের তৈরি করা ২০০৩ সালের ‘করপোরেশন বিজ্ঞাপন নীতিমালা’ বিরোধী। এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন নীতিমালা যেমন অনুসরণ করা হয়নি, তেমনি তৈরি করা হয়নি নতুন কোনও নীতিমালাও।
সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, এর আগে নগরীর বিভিন্ন স্থানে একাধিক এলইডি বিলবোর্ড থাকলেও মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সাঈদ খোকন প্রথম অবস্থায় নগরীর বিভিন্ন সড়ক মোড়ে ১০টি এলইডি বিলবোর্ড লাগানোর অনুমোদন দেন। এরপর একসঙ্গে ছোট আকারের আরও ৫০০টির অনুমোদন দেওয়া হয়। এছাড়া শাহবাগ মোড়ে তিনটি মনিটরের বড় একটি এলইডি বোর্ড স্থাপন করা হয়।
আর বড় বিলবোর্ডগুলো নগরীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে লাগানো হলেও ছোটগুলো লাগানো সড়ক ডিভাইডারে কিংবা ফুটপাতের পাশে। যে কারণে অনেক কাছ থেকেই এলইডি থেকে বিচ্ছুরিত আলো গাড়িচালক ও পথচারীদের চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এর অতিরিক্ত আলো চোখে পড়ায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে চালকদের সমস্যা হচ্ছে। সড়কের জন্য বিপদ ডেকে আনছে এই বিলবোর্ড।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্রাম অফিসার মারুফ রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একজন পথচারী হিসেবে বলতে পারি, এটা চোখের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া চালক ও পথচারীদের চলার পথের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে দুর্ঘটনার মুখে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।’
রাজধানীর কাওরান বাজার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে ছিলেন মোটরসাইকেল চালক মোশারফ হোসেন। মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ করে চোখের সামনে হাত দিয়ে রেখেছেন।
তিনি বলেন, ‘শুনেছি বিপজ্জনক হওয়ায় সিটি করপোরেশন বিলবোর্ড অপসারণ করে এলইডি বিলবোর্ড লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন দেখি এগুলো আরও বিপজ্জনক। যেভাব আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে তার কারণে ড্রাইভিং করতে সমস্যা হচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগের একজন চালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাতে ময়লা নিয়ে কাওরান বাজার ইটিভি মোড় থেকে বাংলামোটরের দিকে ফিরতে দেখি অনেক আলো, হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে আবার আলোকিত হলো। প্রথম অন্ধকারের পর যখন আলোকিত হয়ে উঠলো তখন আর সামনের পথ দেখে উঠতে পারিনি। তখন আমার গাড়ি একটি প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেয়। বড় দুর্ঘটনা না ঘটলেও কারটির পেছনের অংশ চ্যাপ্টা হয়ে যায়। আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। বিলবোর্ডগুলো আমাদের মেয়র সাহেব লাগিয়েছেন, এজন্য কিছু বলতে পারছি না।’
একই কথা জানান, ট্রাক চালক এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, ‘বড়বড় বিলবোর্ডগুলোর আলো অনেক বেশি। হঠাৎ আলো থেকে যখন অন্ধকার হয়ে যায় তখন আর সামনের পথ দেখা যায় না। গাড়ি চালাতে সমস্যা হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সড়ক মোড়গুলোর মধ্যে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা শাহবাগ। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এতে একটি ডিজিটাল বিলবোর্ড বসানো হয়েছিল। সে সময় ডিজিটাল বিলবোর্ড গাড়ি চালকদের মনোযোগ নষ্ট করছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বোর্ডগুলো তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু এখন আবার সেখানে তিনটি মনিটরের একটি বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।
করপোরেশনের বিজ্ঞাপন নীতিমালা-২০০৩-এর ৯ এর ৬ উপধারায় ‘আলোকিত ডিসপ্লের ক্ষেত্রে’ বলা হয়েছে, ‘ট্রাফিক সেফটির প্রতি হুমকি স্বরূপ এরূপ আলোকিত বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। এছাড়া আলোকিত বা বৈদ্যুতিক বিজ্ঞাপন যার তীক্ষ্ণতা ড্রাইভার এবং পথচারীর দৃষ্টিকে ঝলকে দেয়; ফ্লাসিং বিজ্ঞাপন অথবা তীব্র উজ্জ্বলতা বিশিষ্ট সোডিয়াম বাতির বিজ্ঞাপন এবং বিভিন্ন বর্ণে, আঙ্গিকে, উজ্জলতা অথবা ফ্লাসসমৃদ্ধ বিজ্ঞাপন বা অফিসিয়াল ট্রাফিক লাইট, সিগন্যাল সাইন প্রভৃতির জন্য বাধা অথবা এর কার্যকারিতা হ্রাস করে এমন বিজ্ঞাপনও নিষিদ্ধ।’
ওই নীতিমালায় ‘ইলেকট্রিক সাইনের ক্ষেত্রে’ বলা হয়েছে- ‘সড়কের মিডিয়ান ও রাস্তার পাশ থেকে ১০ ফুটের মধ্যে কোনও সাইন লাগানো যাবে না। ট্রাফিক সিগন্যালকে বিঘ্নিত না করে ফুটপাত হতে ৬ মিটার উঁচুতে স্থাপন করতে হবে।’ কিন্তু ডিএসসিসির লাগানো এলইডি বোর্ডে এসব নীতিমালাও অনুসরণ করা হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মৎস্য ভবন থেকে কাকরাইলের প্রধান বিচারপতির বাসভবন হয়ে সোনারগাঁও মোড়, গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে শিক্ষা ও মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে কাওরান বাজার, পান্থকুঞ্জ পার্ক, হেয়ার রোড, আবদুল গনি রোড তাঁতীবাজার ও ধানমন্ডি এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এলইডি বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। এই বিলবোর্ড লাগানোর ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের বর্তমান নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। অপরদিকে নতুন করে কোনও নীতিমালাও তৈরি করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাধারণ সম্পাদক আখতার মাহমুদ বলেন, ‘প্রথমত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এলইডি বিলবোর্ড লাগানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো নয়। বিদেশে যেসব এলাকায় জনসমাগম কম সেখানে লাগানো হয়। আর আমাদের দেশে জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, চোখের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এইগুলো যেখানে লাগানো হয়েছে তার বিপরীত দিক থেকে আসা চালক ও পথচারীদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। চালু হলে এর আলো থাকে এক রকম, আবার বন্ধ হলে হয় অন্য রকম। তাছাড়া অনেক নিচু স্থানে লাগানো হয়েছে এই বিলবোর্ডগুলো। যে কারণে পধচারীদের চলাচলেও অসুবিধা হয়।’
বিলবোর্ড ব্যবসায়ীদের সংগঠন আউটডোর অ্যাডভার্টাইজিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিজিটাল এলইডি বোর্ড যে ঝুঁকিপূর্ণ হবে সেটাও আমরা অনেক আগ থেকেই বলে আসছি। কিন্তু সিটি করপোরেশন আমাদের কথার কোনও পাত্তাই দিল না। এই এলইডি বিলবোর্ড এনালগ বিলবোর্ড থেকেও বেশি বিপজ্জনক।’
এই সংগঠনের অভিযোগ, ‘নগরীতে যেসব ডিজিটাল বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে সেগুলো কোনও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়নি। যারা এই বিলবোর্ড লাগানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তারাও কেউ এ পেশার সঙ্গে জড়িত না। যে কারণে তারা বিলবোর্ডে ত্রুটিগুলো ধরতে পারেনি। তাছাড়া এলইডি বিলবোর্ডগুলোর বৈদ্যুতিক লাইনও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোলেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা নগরীর সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। বিচ্ছুরিত আলোর কারণে সমস্যা হচ্ছে এটা ঠিক না।’ নীতিমালা ভাঙার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, ‘কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল বিলবোর্ড প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।’
এদিকে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লাগানো এলইডি বিজ্ঞাপন বোর্ড থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে এগোতে চায় উত্তর সিটি করপোরেশন। এরই মধ্যে দক্ষিণের এলইডি বোর্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠায়, ডিএনসিসির বিলবোর্ডর দায়িত্বে থাকা প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর মো. আবদুর রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। নীতিমালায় যেভাবে বলা হবে আমরা সেভাবে কাজ করব। এ কারণে এলইডি বিলবোর্ডের বিষয়টি আমাদের এলাকায় আপাতত স্থগিত রয়েছে।’
বাংলা ট্রিবিউন