সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
সবাই নির্বাক। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন একজন নিকটাত্মীয় আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি শান্ত হচ্ছেন না। কয়েক মিনিট পর পর স্মৃতিচারণ করছেন। বলছেন মেধাবী মেয়ের প্রতিভা আর বিভিন্ন গুনের কথা। গান, আবৃত্তি, অভিনয় আর উপস্থাপনাসহ নানান প্রতিভার অধিকারী মেয়ের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মা মোর্শেদা বেগম।
পাবনা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী নিহত তানিজা হায়দারের (২১) ভাড়া বাসায় এ ধরনেরই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে।
রাজশাহী মহানগরীর কাঁচাবাজার লক্ষ্মীপুর এলাকার বাসায় বৃহস্পতিবার বিকালে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। শোকের মাতমে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে।
এর আগের দিন পহেলা ফাল্গুন বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তানিজা। আহত হন তার বন্ধু একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান চৌধুরী।
নিহত তানিজার বাবা সাম্মাক হায়দার বন বিভাগ রাজশাহী কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক। আর মা মোর্শেদা বেগম রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
১৯৯৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তানিজা। দুই বোন এবং এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান মেধাবী তানিজা।
২০১৪ সালে ১৫ বছর বয়সে পাস করেন এসএসসি। ২০১৬ সালে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এসএসসি এবং এইচএসসি দুটি পরীক্ষাতেই কৃতিত্বের পরিচয় দেন। লাভ করেন গোল্ডেন জিপিএ-৫। এরপর ২১০৬ সালেই পাবনা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন তানিজা।
তানিজার ছোট বোন তামিমা হায়দার এসএসসি পরীক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার তার পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল। প্রিয় বোনের লাশ বাসায় রেখেই তিনি পরীক্ষাকেন্দ্রে যান। বোনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তামিমার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।
তিনি বলেন, বোন তানিজা ছিলেন আমার অভিভাবক, বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সবকিছু। তিনি ছিলেন অনুসরণ করার মতো একজন মানুষ। আমার কাছের আদর্শের প্রতীক তিনি। ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, সৎ আর বিনয়ী। অত্যন্ত পরিশ্রমীও ছিলেন তিনি। তার মতো বোনকে হারিয়ে আমি বাকরুদ্ধ।
নিহত তানিজার মা মোর্শেদা বেগমের মতো বাবা সাম্মাক হায়দার কান্নাকাটি না করলেও তিনি ছিলেন একেবারে নিশ্চুপ। তবে মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি কেঁদে উঠেন। বলেন, আমার মেয়েকে নারী বা পুরুষ বিবেচনা করে বড় করিনি। তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। তানিজা ছিল অত্যন্ত মিশুক। ছিল বিনয়ী। তাকে মানুষের সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলা শিখিয়েছি। আর ক্যারিয়ার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিল আমার মেয়ে।
সাম্মাক হায়দার বলেন, বুধবার বিকালে সড়ক দুর্ঘটনার খবর পেয়েই আমরা পরিবারের সদস্যরা মাইক্রোবাসে দ্রুত পাবনার উদ্দেশে রওনা দেই। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস আমি আমার মেয়েকে জীবিত দেখতে পাইনি। তার অনেক আগেই মারা গেছে। মেয়ের মৃত মুখ দেখাই ছিল আমার নিয়তি। মেয়েকে নিয়ে আমার স্বপ্ন ছিল বড়। আর এ কারণে তাকে সেভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার স্বপ্ন পূরণ করতে দিলেন না। তবে আমার তানিজা যেন ওপারে ভালো থাকে সে দোয়া করছি।
এদিকে বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তানিজার লাশ তাদের ভাড়া বাসায় এসে পৌঁছে। এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় মহানগরীর হেতমাঁ গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এ সময় মানুষের ঢল নামে। রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হবিবুর রহমানসহ রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী এবং পাবনা মেডিকেল কলেজের বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দাফনে অংশ নেন।
প্রসঙ্গত, পহেলা ফাগুন উপলক্ষে বুধবার বিকালে বন্ধু ইমরান চৌধুরীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হন তানিজা। সন্ধ্যায় পাবনা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সামনে পেছন থেকে একটি সিমেন্টবোঝাই ট্রাক ধাক্কা দিলে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই তানিজা মারা যান। আর আহত হন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঞ্চমবর্ষের শিক্ষার্থী নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের বাসিন্দা ইমরান।