সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:
ইউক্রেনে অভিযানের কারণে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের সস্তায় তেল কেনার সিদ্ধান্ত আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দুনিয়ার কটাক্ষের মুখে পড়লেও দিল্লি দৃশ্যতঃ সে সমালোচনা গায়ে মাখছে না।
ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল ও এইচপিসিএল এই সপ্তাহেই রাশিয়া থেকে অন্তত ৫০ লক্ষ ব্যারেল অশোধিত তেল কেনার সমঝোতা চূড়ান্ত করে ফেলেছে – আর ভারত সেটা পাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারদরের তুলনায় বেশ সস্তাতেই।
ভারত সরকার যুক্তি দিচ্ছে, যেহেতু ইউরোপের বহু দেশ এখনও রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি করে যাচ্ছে – তাই পশ্চিমাদের মুখে অন্তত ভারতের সমালোচনা করা সাজে না।
‘রাশিয়াকে যারা আজ সমর্থন করছে ইতিহাসই তাদের একদিন বিচার করবে’ বলে আমেরিকা যে প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়েছে, দিল্লি সেটাও উপেক্ষা করছে।
বস্তুত ভারতের বৃহত্তম তেল বিপণনকারী সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল রাশিয়ার কাছ থেকে মোট ৩০ লক্ষ ব্যারেল অশোধিত তেল কিনেছে, আর একটি সংস্থা হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম কিনেছে আরও ২০ লক্ষ ব্যারেল।
উভয় সংস্থার সূত্রেই আভাস মিলেছে, রাশিয়া থেকে পাওয়া এই ‘উরাল ক্রুডে’র দাম পড়েছে ওই তারিখে আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে ব্যারেলে বিশ থেকে পঁচিশ ডলার কম।
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে তেলের দাম আকাশ ছোঁয়ায় ভারত যে তীব্র সঙ্কটে পড়েছিল – তাতে এই সস্তার তেল কিছুটা হলেও তাদের অর্থনীতিকে স্বস্তি দেবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচীর কথায়, “সবাই জানে ভারতকে তেল আমদানি করতে হয় – আর একারণেই আমরা সব সময় গ্লোবাল এনার্জি মার্কেটে নজর রাখি, কখন কোথা থেকে তেল কেনা যায় সেই সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখি।”
“রাশিয়া যদিও আমাদের প্রধান সরবরাহকারী নয়, আমি এটা মনে করিয়ে দিতে চাইব বিশ্বের বহু দেশই – বিশেষ করে ইউরোপ কিন্তু বিপুল পরিমাণে রাশিয়ান জ্বালানি আমদানি করে থাকে।”
ভারতের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী পার্লামেন্টেও জানিয়েছিলেন রাশিয়ার সঙ্গে তার কথা চলছে
দিল্লিতে স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞ সুশান্ত সারিনও মনে করছেন, রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না-করে ভারতকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আর্থিক পরিস্থিতির বিবেচনাতেই।
মি সারিন বিবিসিকে বলছিলেন, “প্রথমত ভারত তেলের একটা নিজস্ব স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ গড়ে তুলতে চায়।”
“তারপর গত দুবছর ধরে কোভিড মহামারিতে অর্থনীতির দশা একেবারে বেহাল – এরপর তেলের দামও এখন মারাত্মক পর্যায়ে, যার পেছনে ভারত কোনওভাবেই দায়ী নয়।”
“এখন যদি দেশের মানুষের স্বার্থে, অর্থনীতির হাল ফেরাতে ভারত কোনও সুযোগে শস্তায় তেল কেনে, আপনি কীভাবে তাদের দোষ দেবেন?”
“রাশিয়ার কাছ থেকে এর চেয়ে অনেক বেশি জ্বালানি জার্মানি বা ইতালি কেনে, আর ভারতের এই সামান্য কেনাকাটায় পুতিনের যুদ্ধের মেশিনারিও সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করি না”, বলছেন মি. সারিন।
ওয়াশিংটনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত মীরা শঙ্কর আবার জানাচ্ছেন, যদিও ভারতের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে যথেষ্ট অসন্তোষ আছে, তারপরও ভারতের যুক্তিও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
তিনি বলছিলেন, “রেকর্ড বলে ভারত কিন্তু বরাবর সেই নিষেধাজ্ঞাগুলো মেনে এসেছে যেগুলো জাতিসংঘ অনুমোদন করেছে – যাকে বলে কম্পালসরি বা বাধ্যতামূলক স্যাংশন।”
“কিন্তু একটি দেশ বা জোট যদি কোনও নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারতের সেটা মানার কোনও দায় থাকতে পারে না। রাশিয়ার ক্ষেত্রে যেমন স্যাংশনটা দিয়েছে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো কিছু দেশ মিলে।”
“তেল বা গ্যাসের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তো আরও সীমিত – কারণ সেটা দিয়েছে শুধু আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়া।”
এই বাস্তবতার নিরিখেই সম্ভবত এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছিলেন, ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল কিনলেই সেটা নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে না।
তবে সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, “ভারতের নেতাদের সঙ্গে আমেরিকা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। চলমান সঙ্কটে কে কোন পক্ষ নিচ্ছে, বাকি দুনিয়া সেদিকে যে সেদিকে নজর রাখছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের তা মনেও করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
আজ কোনও দেশ রাশিয়াকে সমর্থন করলে ইতিহাস যে তাদের ক্ষমা করবে না, এই প্রসঙ্গে সে কথাও তিনি একাধিকবার বলেছেন।
কিন্তু ভারতের পদক্ষেপে এটাও স্পষ্ট যে ইতিহাস নয় – বরং বর্তমান নিয়ে, এবং ডলারের সাশ্রয় নিয়েই আপাতত তারা বেশি ভাবিত।
সূত্র: বিবিসি বাংলা