সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা দেয় মস্কোর ওপর। আর সেকারণেই বহু পশ্চিমা বিলাসবহুল পণ্য রাশিয়ায় যাওয়ার কথা না। তবুও বিলাসবহুল গাড়ির মতো অনেক অভিজাত পশ্চিমা পণ্যই পাওয়া যাচ্ছে রাশিয়ায়।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমা অনেক বিলাসী পণ্যের ব্রান্ড শোরুম গুটিয়ে রাশিয়া থেকে চলে গিয়েছিল। হার্মিস ও ল্যুই ভিঁতোর মতো দামি ব্রান্ডও আছে এই তালিকায়। এরপরে বিলাসবহুল গাড়ি উৎপাদক মেবাখ ও রোলস-রয়েসএর ডিলাররাও রাশিয়ায় ব্যবসা বন্ধ করে।
তবে কোনো লাভ হয়নি। নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলিয়ে বহু বিলাসী পশ্চিমা পণ্য আবার দেদারছে ঢুকছে রাশিয়ায়। আন্তর্জাতিক কাস্টমসের সূত্রগুলো বলছে, দুটি উৎসে এসব পণ্য ব্যাপকভাবে যাচ্ছে; এগুলো হলো রাশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ কাজাখস্তান ও জর্জিয়ায়। এসব দেশ হয়ে পণ্যগুলি যায় রাশিয়ায়।
জার্মানির প্রভাবশালী পররাষ্ট্রনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স এর বিশেষজ্ঞ বেঞ্জামিন হিলগেনস্টক বলেন, ‘ককেশাস ও মধ্য এশিয়া হয়ে এসব পণ্য রাশিয়ায় যাচ্ছে এর পরিস্থিতিগত প্রমাণ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক তথ্যে যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পণ্যগুলোর উৎপাদকরা তাদের বিতরণ ব্যবস্থা সঠিকভাবে মনিটর করছে না। এটা করার তেমন তাগিদও তাদের নেই।’
প্রায় দুই বছর আগে রাশিয়ায় দামি অলঙ্কার ও ৫০ হাজার ডলারের বেশি দামের গাড়ি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইইউ। তবে সঙ্গেসঙ্গেই বিকল্প উপায়ে এসব পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানির উপায়ও তৈরি হয়। শুরুতে এগুলো রপ্তানির জন্য তুরস্ককে ট্রানজিট দেশ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরে দ্বিতীয় রুট হয়ে ওঠে বেলারুশ। নিষেধাজ্ঞার নতুন প্যাকেজের মাধ্যমে এসব ফাঁকফোকর বন্ধ করতে গত গ্রীষ্মে উদ্যোগ নেয় ইইউ। কিন্তু তাতে বেলারুশের মাধ্যমে রপ্তানি কতোটা কমেছে, বা আদৌ কমেছে কিনা ু তা এখনও অজানা।
তবে বর্তমানে রাশিয়ায় পুনঃরপ্তানির সবচেয়ে বড় ফাঁকটা হচ্ছে আরো দক্ষিণে ু জর্জিয়া, আজারবাইজান ও কাজাখস্তান হয়ে। জর্জিয়ার একটি সচিত্র সাংবাদিকতামূলক পোর্টাল আইফ্যাক্ট এর সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে রাশিয়ার সাথে দেশটির সীমান্তকে ‘যানবাহন সমাগমের বেহেশত’ বলে টিপ্পনি কাটা হয়। ককেশাস পর্বতমালার এসব সীমান্তপথে রাজকীয় চালে ছুটতে দেখা যায় পোরশে ও ল্যাম্বারগিনির মতো ব্যাপক দামি গাড়ি, সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যায় রাশিয়ায়ু প্রকৃত মালিকদের হাতে।
এই বাণিজ্য ব্যবস্থা খুবই সুনিয়ন্ত্রিত। এখানে মূল ক্রীড়ানক হলেন গাড়ির চালক, বা যিনি সেটি চালিয়ে পৌঁছে দেন। তার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে অর্ডার দেন রুশ ক্রেতা। এরপর সেই চালক তার নিজের নামে গাড়িটি জর্জিয়ার বাইরে কোথাও রেজিস্ট্রেশন করান এবং একটি বিমা পলিসিও নেন। জর্জিয়া ও রাশিয়ার প্রাকৃতিক সীমানা নির্দেশ করেছে ককেশাস পর্বতমালা, যেখানে মূল চলাচলের পথ হচ্ছে লার্স পাস। এই গিরিপথ পাড়ি দেওয়ার পরে গাড়িটি প্রকৃত মালিকের কাছে অথবা তার প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করে জর্জিয়ায় ফিরে আসেন। আবার নতুন অর্ডার পেলে একইভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়।
জর্জিয়া থেকে আসার পর গাড়িগুলো নিয়ে যাওয়া হয় মস্কো বা সেন্ট পিটাসবার্গের মতো বড় শহরগুলিতে। মস্কো যেতে পাড়ি দিতে হয় ১৮শ’ কিলোমিটার ও সেন্ট পিটাসবার্গে যেতে ২৫শ’ কিলোমিটার। এই পুরো পথে গাড়ির অন্যান্য চালক, মধ্যস্বত্বভোগী ও সরকারি কর্মকর্তাদের আকর্ষণীয় এই বাণিজ্যের থেকে ডলার, ইউরো, রুবল ইত্যাদিতে অর্থ প্রদান করা হয়। অসাধু এই বাণিজ্যে লাভবান হছে সবাই, কেবল ইউক্রেন বাদে।
তথ্য বলছে, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ককেশাস অঞ্চলের এই দেশটি বছরে গড়ে ৫০ হাজার গাড়ি রপ্তানি করেছে, ২০২২ সালে (ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে) যা উন্নীত হয় ৮০ হাজারে, এবং গত বছরে রপ্তানি করেছে ১ লাখ ৮ হাজার কার। পুনঃরপ্তানির এই বাণিজ্য থেকে আগে প্রতি বছরে মাত্র ৪৩ কোটি ডলার আয় করতো জর্জিয়া, যা এখন ২১৬ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিটি গাড়ির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি রাখা হচ্ছে।
এই পুনঃরপ্তানি করা গাড়ির বড় অংশ আবার যাচ্ছে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও কিরগিজস্তান হয়েও। এই দেশগুলো রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পশ্চিমা পণ্য সরবরাহ করছে। আর সেটা জর্জিয়ার সরকারও জানে।
রাশিয়ার ওতক্রিতিয়ে ব্যাংক ও অ্যাভতোমার্কেটলগ চ্যানেলের এক গবেষণা অনুযায়ী, রাশিয়ায় আমদানি করা গাড়ির ৮ শতাংশ চোরাইপথে আসে। তবে এসব গাড়ির বেশিরভাগই হচ্ছে অত্যন্ত দামি। যেকারণে দেশটির অনলাইন বিক্রিবাট্টার পোর্টালে চোখ বুলালেই দেখা যায়, কম বা মাঝারি দামের গাড়ি কেনার দিকে ধনীদের তেমন ঝোঁক নেই। তাদের যত ঝোঁক বিলাসবহুল ইউরোপীয় ও উচ্চ মানের চীনা গাড়ির দিকে। চীনা র্ব্যান্ডের মধ্যে চাহিদার শীর্ষে আছে লিশিয়াং ও জিকর।
চোরাইপথে আসা গাড়ি কেনার দুটি পথ রয়েছে, এরমধ্যে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে কোনো ডিলারের সাথে যোগাযোগ করা, যে গাড়ির বড় চালান আমদানি করার মতো আর্থিক সামর্থ্য রাখে। তবে রুশ ক্রেতা যদি নির্দিষ্ট কোনো মডেলের গাড়ি পেতে চান, তাহলে এমন মধ্যস্ততাকারীর শরণাপন্ন হওয়াই তাঁর জন্য সবচেয়ে কার্যকর, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যার যোগাযোগ রয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন