বুধবার , ১০ জুলাই ২০২৪ | ৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

নির্বাচনের আগে ৪৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন

Paris
জুলাই ১০, ২০২৪ ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

 

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের তিন মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের হিড়িক পড়েছিল। ওই সময় প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়, যা আগের তিন মাসের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৯ গুণ বেশি। এক ত্রৈমাসিকের হিসাবেও এটি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

এই ঋণের প্রায় ৯২ শতাংশই পুনঃতফসিল করে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলো। সব মিলে গত বছরের পুরো সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছরের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে সে সময় অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এ ছাড়া বছর শেষে নিজেদের আর্থিক হিসাব ভাল দেখাতেও ওই প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদার হস্তে নবায়ন করে ব্যাংকগুলো।

গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আর যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, অন্যথায় প্রার্থী হতে পারেন না। সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সে সময় বাছবিচার ছাড়াই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। কারণ ২০২২ সালের জুলাইতে এসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালাও শিথিল করা হয়।

এ ছাড়া বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চার বার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, আগে তিন বারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না। এ ছাড়া ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। আর ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় খেলাপি ঋণ নবায়ন বেড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ছাড় দেওয়াটা ইতিবাচক কিছু বয়ে আনছে না। উল্টো যে ঋণগুলো পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হচ্ছে, সেই ঋণ পরিশোধে তালবাহানায় আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক পুনঃতফসিলের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কারণ অনেকে নির্বাচন অংশগ্রহণ করতে চান। কিন্তু ঋণখেলাপি থাকার কারণে করতে পারেন না। যেহেতু গত নির্বাচন ডিসেম্বর প্রান্তিকের পরপরই হয়েছে, তাই নির্বাচনের কারণেই ঋণ পুনঃতফসিল বেশি হয়েছে। নির্বাচনের আগে এটা সব সময়ই বাড়ে। এসব রাজনৈতিক ইস্যু। ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতা হিসেবে করুক বা সরকারের নির্দেশে করুক, তারা কিন্তু করে ফেলে। এটা ভালো কোনো দৃষ্টান্ত নয়। তবুও আমাদের দেশে প্রচলন হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলো ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ছাড় দিয়েছিল। বিশেষ করে করোনার প্রভাব শুরুর পর কেউ কোনো টাকা না দিলেও তাকে খেলাপি করা হয়নি। আস্তে আস্তে এ সুবিধা তুলে দিতে থাকে। এই বছরের শেষের দিকে সুবিধাগুলো একেবারে তুলে দেওয়া হয়। এ কারণে গত ডিসেম্বর প্রান্তিক তোড়জোড় করে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বেশি করেছে। এ ছাড়া প্রতি বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায় ও পুনঃতফসিল বেশি করে থাকে। কারণ ডিসেম্বরকেন্দ্রিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি হয়। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যেও এ সময়ে অনেক প্রার্থী ঋণ নবায়ন করেন। সব মিলে ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে।

নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণ নবায়নে হিড়িক : ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ৪৩ হাজার ৮২৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এটি আগের তিন মাসের চেয়ে সাড়ে ৯ গুণ বেশি। আগের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ৪ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ৩ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। আর এপ্রিল থেকে জুন সময়ে পুনঃতফসিল করা হয় ১০ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। সব মিলে গত বছর ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। আগের বছরের (২০২২ সাল) পুরো সময়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। মূলত নীতিমালায় ঢালাও ছাড় দেওয়ার কারণে ওই বছর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে রেকর্ড গড়েছিল।

৯২ শতাংশের বেশি করেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংক : এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার প্রবণতা বেশি ছিল। তবে পুনঃতফসিলের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকের পর্ষদের হাত ছেড়ে দেওয়ার পর সেই প্রবণতা এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোই সিংহভাগ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে। এ সময়ে ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল করে প্রায় ৪০ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, যা মোট পুনঃতফসিল ঋণের ৯১ দশমিক ৯২ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ২০৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ছয় ব্যাংক। আর ১ হাজার ৭২ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করে তৃতীয় অবস্থানে বিশেষায়িত খাতের ব্যাংক। আর বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো করেছে ২৬৪ কোটি টাকা। পুনঃতফসিল বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বছরের শেষে খেলাপি ঋণ কমানোর একটা চাপ থাকে। কারণ বুক ক্লিন করার জন্য ব্যাংকগুলো নগদ আদায়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি পুনঃতফসিলে ঝুঁকে। এটা প্রতিবছরই হয়ে থাকে।

নবায়নের চাপে কিছুটা কমে খেলাপি ঋণ : রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়নেরও পরও গত বছরের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে মাত্র ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এতে ২০২৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা এক বছর আগেও ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ফলে বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরে প্রথম ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। আর এ কারণে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে অস্বাভাবিক বেড়েছে খেলাপি ঋণ, এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপিঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।

জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ৩০০টি আসনের বিপরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ মোট ২ হাজার ৭১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে এসব প্রার্থীরা ঋণখেলাপি কিনা সেই তথ্য ঋণতথ্য ব্যুরো (সিআইবি) থেকে যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাচাই-বাছাইয়ে অন্তত ১১৮ জন প্রার্থী ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হন। বাকিদের কেউ কেউ আগেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করেন। তবে ঠিক কতজন প্রার্থী খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেছেন সেই তথ্য জানা যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণে ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেশি পুনঃতফসিল হয়েছে। কারণ আমাদের দেশের অনেক নেতাই ঋণখেলাপি। তাই নির্বাচনের আগে অনেক প্রার্থী ঋণ নবায়ন করেন। এর প্রভাবে অস্বাভাবিক পুনঃতফসিল হয়েছে।

 

 

সর্বশেষ - অর্থ ও বাণিজ্য