নিজস্ব প্রতিবেদক:
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীভিত্তিক কর্মসুচিগুলো দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হলেও পর্যাপ্ত এবং সর্বজনীন না হওয়ায় মানুষের জীবনমানের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হয়ে উঠছে না। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি মোকাবেলার পদক্ষেপ গৃহীত হলেও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে দিশেহারা মানুষ নানাভাবে পারিবারিক ব্যয় সংকুচিত করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকিতে আছে। খাদ্য অধিকার সপ্তাহ পালনের অংশ হিসেবে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে ‘নাগরীক সংলাপ খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি: খাদ্য পন্যের মূল্য বৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ’ শীর্ষক এক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে উৎপাদক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত ধাপে ধাপে ফড়িয়া করপোরেট কারসাজি বন্ধ করতে সাগরীক সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। খাদ্যপন্য ব্যবসায় হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির দৌরাত্ব প্রতিরোধ করতে হবে। যারা ওএমএস এর লাইনে আসতে পরছে না তাদের কাছে ন্যয্য মূল্যে খাবার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বপরি খাদ্য নিরাপত্তা আইন পাশ করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক-খানি, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক-প্রান একশন এইড, এবং পরিবর্তনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপে সভাপতি ছিলেন পরিবর্তন পরিচালক রাশেদ রিপন। বক্তব্য দেন সিনিয়র সাংবাদিক মুস্তাফিজুর রহমান খান, ভূমি অন্দোলন কর্মী এবং রুলফাও এর নির্বাহী পরিচালক আফজাল হোসেন, বারসিকের বিভাগীয় সমন্বয়কারি শহিদুল ইসলাম, সংস্কৃতি কর্মী ও চিত্রকর আশফাকুল আশেকিন এবং অগ্নি প্রকল্পের সমন্বয়কারি হাসিবুল হাসান। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিবর্তনের প্রোগ্রাম অফিসার সোমা হাসান। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল শিশু চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা এবং সন্ধ্যার পরে বাউল গান পরিবেশন করা হয়।
সংলাপে বক্তারা বলেন, ’ মানুষের খাদ্যের অধিকার মানবাধিকার, তাই নাগরিকের খাদ্য অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। করোনা মহামারীর মানুষের জীবন, জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তাসহ গোটা অর্থনীতিতে একটি উলে¬খযোগ্য আঘাত। তারপরেও যখন মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা। বেশ কিছু গবেষণা বলছে করোনাকালেই দেশে নতুন দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটিরও বেশি মানুষ। শুধু এই দরিদ্র বা হতদরিদ্ররা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরাও, বিশেষত যাদের আয় নির্দিষ্ট। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের সর্বশেষ জরিপ বলছে করোনাকালে আর্থিক দুরবস্থায় টিকে থাকতে খাবার ব্যয় কমিয়েছে ৪৩ শতাংশ মানুষ। এতে করে তাদের স্বাস্থ্যের যেমন অবনতি ঘটছে তেমনি পুষ্টিহীনতার কারণে কর্মশক্তি হ্রাসের আশংকাও করছেন পুষ্টিবিদরা।
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তারা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি হলেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে এর সুফল জনগনের কাছে কতটা পৌঁছেছে তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। টিসিবি ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ এবং ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) এর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি করা হয়েছে, এর সাথে সাথে দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবি ও ওএমএস পণ্যের জন্য দাঁড়ানোর লাইন। অনেকে শ্রমঘন্টা নষ্ট করে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করছেন, আবার কেউ প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে না পেরে খালিহাতে ফিরছেন। সরকারি পরিষেবাগুলোয় উপকারভোগী নির্বাচনে রয়েছে স্বজনপ্রীতি ও চরম অনিয়মের অভিযোগ।
সরকারি বেসরকারি খাতে চালের সরবরাহ বাড়াতে ও দাম কমাতে আমদানি শুল্ক হ্রাস করা এবং চাল আমদানির উদোগ নেয়া হলেও চাল-গমের দাম যেমন বেড়েছে, সবজি, ডিম, ডাল, মাছ, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে নিয়মিত। দেশের সাধারণ জনগণের উপর মূল্যের অভিঘাত প্রশমন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রান্তিক ও শ্রমজীবি আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানো সহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান বক্তারা।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সরকারি কর্মকর্তা, কৃষক, নারী কৃষক, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগী, শ্রমিক, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষাবিদ, স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ শতাধিক অংশগ্রহণকারী এই সংলাপে অংশ নেন।