নিজস্ব প্রতিবেদক, নওগাঁ:
বাংলা ভাইয়ের সহযোগী জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নওগাঁর ২০ ক্যাডারকে ১৩ বছর থেকে খুঁজছে পুলিশ। তবে সেই ক্যাডাররা কোথায় কী অবস্থায় আছে তার কোন তথ্যই নেই পুলিশের কাছে। এমনকি তাদের ছবিও নেই বলে জানিয়েছেন নওগাঁর পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বিপিএম, পিপিএম।
পুলিশ সুপার সিল্কসিটি নিউজকে জানান, এই ২০ জন জেএমবি’র মধ্যে কয়েকজন বিদেশে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ তাদের পরিচয়, ছবি সংগ্রহ ও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে তথ্য নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে।
জানা গেছে, জঙ্গি সন্ত্রাসীরা ১৯৯৮ সালের ৩ মার্চ আত্রাই উপজেলার যুবলীগ নেতা লাল মোহাম্মদ লালুকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যার মাধ্যমে রাণীনগর-আত্রাই উপজেলায় ত্রাস শুরু করে। এরপর থেকেই শুরু হয় ওই এলাকায় অস্ত্রের ঝনঝনানী আর অজানা আতংক। এরপর থেকে একেরপর আওয়ামী লীগের নেতারা হত্যার শিকার হন।
১৯৯৮ সালের ২১ মে আত্রাইয়ে কৃষকলীগ নেতা গোলাম নবী, ১০ ডিসেম্বর আওয়ামীলীগ নেতা ও মুনিয়ারী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুল লতিফ মেম্বার, ১৯৯৯ সালে ৩০ মার্চ খুন হন আত্রাই উপজেলার আওয়ামীলীগের সভাপতি এ্যাডঃ সিদ্দিকুর রহমান রাজা ও শ্রমিকলীগের আহবায়ক অরুন সরকার। চরমপন্থী-সর্বহারারা গুলি ও জবাই করে তাদের হত্যা করে। এরপর এভাবেই চলতে থাকে একের পর এক হত্যাকা-অ। ২০০০ সালে ১৯ জুন রাণীনগর উপজেলার ছাত্রলীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম নজু, ২০০১ সালের ১৫ মার্চ রাণীনগর উপজেলার আওয়ামীলীগ নেতা মজিবর রহান ওরফে কানা মজিবর, ২০০২ সালের ১০ জানুয়ারি আত্রাই উপজেলার সিংসাড়া গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা মজিবর রহমান, ২২ মে আত্রাই উপজেলার যুবলীগ নেতা ভুট্টু প্রাং, ২০০৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ঈদের রাতে আত্রাই উপজেলার মদনডাঙ্গা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন, ৩ এপ্রিল আত্রাই উপজেলার ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সালামত হোসেন ওরফে সুবাস চৌধুরী, ২৪ এপ্রিল ভোর রাতে আত্রাই উপজেলার নৈদীঘি গ্রাম ঘিরে চারটি পরিবারের মধ্যে মুনিয়ারি ইউপির নব-নির্বাচিত মেম্বার ও বিএনপি নেতা শুকবর আলীসহ তার ভাই বিএনপি নেতা আব্দুল জব্বার, বিএনপি নেতা মোজাম্মেল হোসেন, ও তার ছোট ভাই বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেন বিদ্যুৎ, বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর ও শাজাহানসহ ছয় জনকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়। ২১ জুন রাণীনগর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাণীনগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসেন মাষ্টার, ২২ সেপ্টেম্বর আত্রাই উপজেলার যুবদল নেতা ও ঠিকাদার আইনুল হক ভুট্টু ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি রাণীনগর উপজেলার একডালা ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা আফজাল হোসেনকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার সাথে চরমপন্থী অর্থাৎ সর্বহারাদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ওই নেতার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় সর্বহারারা। তৎকালীন বিএনপি জামাত জোট সরকারের তত্ত্বাবধানে রাজশাহীর সাবেক ডাক তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আমিনুল হক, নাটোরের সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ও আত্রাই-রাণীনগরের সাবেক এমপি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির সর্বহারা দমনের নামে একই বছরের ৪ এপ্রিল শায়েখ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে ‘বাংলা ভাই’ নেতৃত্বে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর আর্বিভাব ঘটায়। সে সময় পুলিশি পাহারায় শতশত জেএমবি ক্যাডাররা রাণীনগর ও আত্রাইয়ে সর্বহারাদের দমন নামে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ, মারপিট, লুটতরাজ, নির্যাতন, ঘরবাড়ি ভাংচুর। এ সময় রাণীনগর উপজেলার ভীটি মাদ্রাসায় ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামে দুটি নির্যাতনী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এই দুটি ক্যাম্পে প্রায় ২ মাস আশেপাশে এলাকার শতশত কথিত সর্বহারাদের ধরে এনে মারপিট ও নির্যাতন করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২২ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
নিহতদের মধ্যে ২৬ এপ্রিল ভৌঁপাড়া গ্রামের ফরিদুল ইসলাম কালুকে পিটিয়ে, ২৭ এপ্রিল আত্রাইয়ে কাশিয়াবাড়ি গ্রামের স্বপনকে পিটিয়ে, ৬ মে আত্রাইয়ের জামগ্রাম গ্রামের জেএমবির ক্যাডার জিল্লুর রহমান ও আব্দুল মজিদকে জবাই করে, ১৭ মে রাণীনগর উপজেলার সরিয়া গ্রামের জেএমবি ক্যাডার নজরুল ইসলাম ও আব্দুর রশিদকে জবাই করে, ২০মে রাণীনগর উপজেলার সিম্বা গ্রামের খেজুর আলী ও আব্দুল কাইউম বাদশাকে অপহরণের পর জেএমবি ক্যাডাররা (জেএমবি মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনে মৃত্যু হলে লাশ উল্টো করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ২৭ মে আত্রাই উপজেলার কাশিয়াবাড়ি গ্রামের দ্বিপঙ্করকে পিটিয়ে, ১৪ নভেম্বর রাণীনগরে জেএমবি ক্যডাররা কালিগ্রাম ইউপি আওয়ামীলীগের সভাপতি জিয়াউল হক জিয়াকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
২০০৪ সালের জেএমবির তান্ডবের সময় খেজুর আলী ও আব্দুল কাইউম বাদশা হত্যা বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। নওগাঁর আত্রাই-রাণীনগর থেকে জেএমবির জন্ম হলেও পাশ্ববর্তী জেলা রাজশাহী, নাটোর, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃতি হয়।
জামায়াত-বিএনপির জোট সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক অবস্থায় বাংলা বাহিনী বা জেমবি মিডিয়ার সৃষ্টি বলে আড়াল করার চেষ্টা করলেও অবশেষে ২০০৫ সালে সরকার জেএমবি’কে নিষিদ্ধ করে । সর্বশেষ ২০০৬ সালের ২১ মে রাণীনগর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের জেএমবি ক্যাডার আরিফ শেখকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে চরমপন্থীরা। এ সময়ের মধ্যে পুলিশ ও র্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে অন্তত ১৫ চরমপন্থি নিহত হয়েছে। জঙ্গি সন্ত্রাসী জেএমবি নেতা শায়েখ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরুফে বাংলা ভাইকে বিচারের আওতায় তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। কিন্তু সেই বাংলা ভাই জেএমবির জন্মদাতা নেপথ্যের নায়কেরা আজ ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। পুলিশের পক্ষ থেকে একশ’র বেশি জেএমবি ক্যাডারদের তালিকা করা হয়। জেএমবি’র তান্ডবের পর থেকে ২০ জন জেএমবি ক্যাডারকে আজও খুঁজে পায়নি পুলিশ। এদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশে রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে।
পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক জানান, সম্প্রতি জেলার ১৯জন জেএমবি’র ক্যাডারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও জেএমবি’র তা-বের পর থেকে নিখোঁজ ২০ জেএমবি ক্যাডারে অবস্থান, সর্ম্পকে খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অপর জেএমবি সদস্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
স/মি