সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:
মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকা-ের সুরাহা হয়নি ১১ বছরেও; ধরা পড়েননি নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড আজমেরী ওসমান। ২০১৩ সালের মার্চে ত্বকী হত্যাকা-ের পর বিচারের দাবিতে সবাই সোচ্চার হলে আত্মগোপনে চলে যান শামীম ওসমানের ভাতিজা এবং জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী। একপর্যায়ে দেশ ছাড়েন। কিন্তু কয়েক মাস পরই আবার দেশে ফিরে আসেন। গত কয়েক বছর ধরে আজমেরী ওসমানকে নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্যে দেখা গেলেও তাকে ধরেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন র্যাব তাকে খুঁজছে। কিন্তু আজমেরী ওসমান ও তার পরিবার ইতোমধ্যেই ফের আত্মগোপনে চলে গেছেন। তারা কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারছেন না।
ত্বকীর বাবা বলছেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে মামলার তদন্ত বন্ধ ছিল। প্রসঙ্গত, সে সময় সংসদেও সরকারপ্রধান বলেছিলেন, তিনি ওসমান পরিবারের সঙ্গে আছেন। এর পরই র্যাবের তদন্ত কার্যত থেমে যায়। শুধু তাই নয়। আজমেরী ওসমানসহ ১১ আসামিকে অভিযুক্ত করে খসড়া চার্জশিট দাখিলের পর সরিয়ে দেওয়া হয় তদন্ত কর্মকর্তাকেও।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর র্যাব নতুন করে ত্বকী হত্যাকা-ের তদন্ত শুরু করেছে। হত্যাকা-ের ১১ বছর পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে আজমেরী ওসমানের গাড়িচালক জামশেদ শেখসহ ৪ জনকে। গ্রেপ্তার হওয়া অপর তিন আসামি হলেন শাফায়েত হোসেন শিপন, মামুন মিয়া ও কাজল হাওলাদার। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আজমেরী ওসমানের গাড়িচালক জামশেদ শেখ ত্বকী হত্যাকা-ের বিষয়ে মুখ খুলেছেন। হত্যাকা-ের পর আজমেরী ওসমানের নির্দেশে ত্বকীর লাশ কীভাবে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়েছিল, সেই বর্ণনাও দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তে নতুন গতি দৃশ্যমান হচ্ছে। হত্যাকা-ে কার কী ভূমিকা ছিল, তাও নতুন করে স্পষ্ট হচ্ছে র্যাবের তদন্তকারীদের কাছে।
৪ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে কী পাওয়া গেছে? এমন প্রশ্নে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা গত বৃহস্পতিবার বলেন, তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা তথ্য আদায়ের চেষ্টা করছি। যেহেতু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা তাই আমরা এটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। পরদিন তার ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। এতে দেখা যায়, মেধাবী এই কিশোর পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে সারাবিশ্বে সর্বোচ্চ ২৯৭ নম্বর পেয়েছিলেন। নিখোঁজের দুদিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর প্রথম তিন মাস তদন্তের দায়িত্ব ছিল পুলিশের হাতে। পরে ওই বছরের ২০ জুন রফিউর রাব্বির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাবকে। তবে দীর্ঘ সাড়ে ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি র্যাব।
২০১৪ সালের ৫ মার্চ র্যাবের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বলা হয়- ত্বকী হত্যায় আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কোনো দিন মামলার চার্জশিট দাখিল করা হবে। কিন্তু ১১ বছরেও মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়নি। সে সময় ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন র্যাব-১১ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে অবসরে) রবিউল হক। তিনি তদন্তভার গ্রহণের পরই হত্যাকা-ের রহস্য বের হয়ে আসে। তিনি আজমেরী ওসমানসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সাক্ষ্যের স্মারকলিপি (খসড়া চার্জশিট) দাখিল করেন। পরে খসড়া চার্জশিট অনুমোদন না করে র্যাব সদর দপ্তর কয়েকটি বিষয়ে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই অধিকতর তদন্ত ১১ বছরেও শেষ হয়নি। উল্টো সে সময় তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের পাশে আছেন। এরপর র্যাবের তদন্ত দৃশ্যত থেমে যায়। এমনকি তৎকালীন র্যাব-১১ অধিনায়ক লে কর্নেল জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাদিরা খাতুন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র এএসপি রবিউল হককে ব্যাটালিয়ন থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়। এরপর আর মামলার তদন্ত এগোয়নি।
এএসপি রবিউল হক যে খসড়া চার্জশিট দাখিল করেছিলেন তাতে উল্লেখ ছিল- ত্বকীকে কেবল হত্যার পরিকল্পনাই নয়, বরং এই হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন আজমেরী ওসমান। তার নির্দেশে, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ তার সহযোগীরা ত্বকীকে অনুসরণ করে এবং তাকে অপহরণ করে শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে উইনার ফ্যাশনে তার ‘টর্চার সেলে’ নিয়ে যায়। পরে ওই রাতে, আজমেরী ও তার সহযোগীরা ১৭ বছর বয়সী ত্বকীকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করে। এরপর তার লাশ বস্তায় ভরে আজমেরীর গাড়িতে করে চারারগোপ এলাকায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে রাত ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে ঘাতকরা নৌকায় করে লাশ নিয়ে কুমুদিনী জোড়া খাল এলাকার শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। পরদিন ৮ মার্চ নদী থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, আজমেরী ওসমান ছাড়া অন্য অভিযুক্তরা হলেন ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর, তায়েবউদ্দিন জ্যাকি, রাজীব, কালাম শিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন ও জামশেদ হোসেন। র্যাব অভিযুক্ত লিটন, ভ্রমর, জ্যাকি এবং সন্দেহভাজন হিসেবে রিফাত বিন ওসমান ও সালেহ রহমান সীমান্তকে গ্রেপ্তারও করে। তবে সবাই পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০১৪ সালের জুলাই ও নভেম্বর মাসে যথাক্রমে লিটন ও ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা থেকে হত্যা পর্যন্ত সব ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তী সময়ে ভ্রমর আদালতে জবানবন্দিতে তার দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারেরও আবেদন জানিয়েছিলেন। পরে ভ্রমর ও লিটনসহ এই মামলার সব আসামি আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে যান।
তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা রবিউল হক গতকাল শুক্রবার আমাদের সময়কে জানান, তদন্ত করে ত্বকী হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করেন তিনি। আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করতে সাক্ষ্যের স্মারকও দাখিল করেছিলেন। কিন্তু বদলি হওয়ার পর মামলাটির তদন্ত কোনপথে গিয়েছিল, তা তিনি বলতে পারছেন না।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মামলাটির চার্জশিট যেন আদালতে দাখিল না করা হয়, সে জন্য র্যাবের ওপর তৎকালীন সরকারের অদৃশ্য চাপ ছিল। আজমেরীকে রক্ষায় ওসমান পরিবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদবির করেছিল। ফলে চার্জশিট দাখিল প্রক্রিয়া আটকে যায়। উপরন্তু বদলি হয়ে যান তদন্ত কর্মকর্তাসহ র্যাবের তিন কর্মকর্তা। এ ঘটনার পর আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্যে আসেন। প্রায় রাতেই তাকে শহরে মহড়া দিতেও দেখা যায়। অথচ র্যাব আজমেরী ওসমানকে গ্রেপ্তার করেনি।
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, হত্যাকা-ের এক বছরের মধ্যে র্যাবের তদন্তে সব বেরিয়ে এসেছিল। কীভাবে ওসমান পরিবারের টর্চার সেলে ত্বকীকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলা হয়। সে সময় সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয়ে জানিয়েছিল র্যাব। কিন্তু যখনই শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেন, তখনই এ মামলার সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, মামলার তদন্ত সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে বন্ধ ছিল। নতুন করে যে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের নাম অপর এক আসামির জবানবন্দিতে এসেছিল। কিন্তু এর আগে তারা কখনই গ্রেপ্তার হননি।
ত্বকীর বাবা বলেন, তদন্ত কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা সঠিকভাবে এগোচ্ছে বলে আমি মনে করি।
রফিউর রাব্বি বামপন্থি নেতা ও সাংস্কৃতিক জোটের সংগঠক। এ ছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিরও একজন সংগঠক। সিটি নির্বাচনের সময় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে তিনি ব্যাপক প্রচার চালান। এতে তার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল ওসমান পরিবার। যার জের হিসেবে লাশ হতে হয় মেধাবী ছাত্র ত্বকীকে।