সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
দুদিন আগে লিখেছিলাম, নয়ন বন্ড কার লোক? অর্থাৎ কাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে একজন নয়ন বন্ড তৈরি হয়েছিল?
বরগুনা আওয়ামী লীগের দুই বিবদমান গ্রুপের নেতারা বলেছিলেন, ‘ও আমাদের নয়, ওদের লোক।’ নয়ন বন্ড বেঁচে থাকলে বলতে পারতেন, সত্যি সত্যি তিনি কার লোক ছিলেন।
শুধু বরগুনা নয়, আরও অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, কোনো অপরাধী বা সন্ত্রাসী হাতেনাতে ধরা পড়লে নেতারা অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। এটা কারও অজানা নয় যে রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে থাকেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে তাঁরা খুবই পারঙ্গম। বগুড়ার তুফান সরকারের বেলায়ও সেটা দেখেছিলাম।
অভিযোগ আছে, নয়ন বন্ড আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁকে যুবলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। মজার বিষয় হলো বরগুনা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ একে অপরকে অভিযুক্ত করলেও কেউ বলছে না যে নয়ন বন্ড বিএনপি বা জামায়াতের লোক ছিলেন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেছেন, নয়ন ছিলেন সাংসদ পুত্র সুনাম দেবনাথের ঘনিষ্ঠ। আর সাংসদ পুত্রের অভিযোগ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানই তাঁদের আশ্রয়দাতা।
নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে এই প্রথম অভিযোগ ওঠেনি। মাদক, ছিনতাই, প্রতিপক্ষকে মারধরসহ তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা ছিল। তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার সদর্পে জেল থেকে বেরিয়েও এসেছেন। কিন্তু কীভাবে বেরিয়ে এলেন, কারা বেরিয়ে আসতে সহায়তা করেছেন, সেটি খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
সারা দেশে যখন নয়ন বন্ডকে নিয়ে সরগরম আলোচনা চলছিল, তখনই খবর এল রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ ওরেফ ‘নয়ন বন্ড’ পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার ভোর সোয়া চারটার দিকে বরগুনার পুরাকাঠা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা হয় বলে জানানো হয়। এ সময় নয়ন বন্ড নিহত হন। এ ঘটনায় এএসপিসহ ৪ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
পুলিশের ভাষ্য, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রিফাত শরিফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডকে গ্রেপ্তার করতে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়ির চর ইউনিয়নের পুরাকাটা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশের ওপর গুলি চালান নয়ন বন্ড ও তাঁর সহযোগীরা। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলির একপর্যায়ে নয়ন বন্ড বাহিনী পিছু হটলে ঘটনাস্থলে তল্লাশি করে নয়ন বন্ডের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, এক রাউন্ড গুলি, দুটি শটগানের গুলির খোসা এবং তিনটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
এ রকম একজন দুর্ধর্ষ অপরাধীকে জীবিত ধরে বিচার করা জরুরি ছিল। কিন্তু পুলিশ তাঁকে মৃত উদ্ধার করেছে। একটি ছবিতে দেখলাম কলাপাতার ওপর তাঁর লাশ পড়ে আছে। একটি হাফ প্যান্ট পরা। অথচ তিন দিন আগেও তাঁর ভয়ে বরগুনা প্রকম্পিত ছিল।
নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় অনেক কিছুই জানা যাবে না। কীভাবে তিনি অপরাধের জগতে এলেন? কারা তাঁকে মাঠের সৈনিক হিসেবে ব্যবহার করেছেন, আর তিনি কাদের ব্যবহার করেছেন সিঁড়ি হিসেবে?
একটি সংবাদমাধ্যমে নয়ন বন্ডের মা সাহিদা বেগমের কিছু বক্তব্য ছাপা হয়েছে। রিফাত শরিফ হত্যার দিন বেলা ১১টায় নয়ন মাকে ফোন করেন। ফোন ধরেই তিনি বলেন, ‘এ নয়ন, তুই নাকি কারে কোপাইছ। আহারে কার মায়ের কোল খালি করছ।’
ওই সময় নয়ন বলেন, ‘কোপাইছি ঠিক করছি, তুমি আমার জামাকাপড় দাও আর টাকা জোগাড় করো।’ এ কথা বলেই বাসার কাছাকাছি একটি দোকানের পেছনে আসে। সেখান থেকে একটি ছেলেকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। নয়নের মা ওই ছেলের কাছে একটি টি-শার্ট ও প্যান্ট পাঠিয়ে দেন। পরে আবারও নয়ন তাঁকে টাকা পাঠাতে বলে। এবার নয়নের মা নিজে গিয়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে আসেন। এরপর নয়ন ও রিফাত টাকা নিয়ে কেজি স্কুল সড়কের এক বন্ধুর বাড়িতে যান। সেখানে তাঁরা তিনজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় নয়ন মোবাইল ভেঙে ফেলতে চাইলে একজন ফোনটি রেখে টাকা দিয়ে দেন।
এতেই বোঝা যায়, নয়ন বন্ড কতটা ভয়ংকর ছিলেন। রিফাত হত্যা মামলার ৯ আসামি গ্রেপ্তার হলেও নয়ন বন্ডের দুই প্রধান সহযোগী রিফাত ফরাজি ও রিশান ফরাজি এখনো পলাতক।
সোমবার পর্যন্ত ৯ জন গ্রেপ্তার হন। তাঁরা হলেন চন্দন (২১), মো. হাসান (১৯), অলিউল্লাহ (২২), টিকটক হৃদয় (২১) এজাহারভুক্ত আসামি। ঘটনার পরের দিন সকালে চন্দনকে, সন্ধ্যায় মো. হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। রোববার বরগুনা থেকে অলিউল্লাকে (২২) এবং ঢাকা থেকে টিকটক হৃদয়কে (২১) গ্রেপ্তার করা হয়। অন্য পাঁচজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন নাজমুল ইসলাম (১৮), সাগর (১৯), তানভীর (২২), কামরুল হাসান ওরফে সাইমুন (২১)। অপর একজনের নাম পুলিশ প্রকাশ করেনি।
সোমবার বিকেলে এই মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি অলিউল্লাহ ওরফে অলি ও তানভীর হোসেন ১৬৪ ধারায় বরগুনার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বিকেলে বরগুনার বিচারিক হাকিম সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে ওই দুই আসামিকে উপস্থিত করে তাঁদের দুজনের এই জবানবন্দি নেওয়া হয়। অলিউল্লাহ রিফাত হত্যা মামলার ১১ নম্বর আসামি, তাঁকে রোববার গ্রেপ্তার হয়। অপর আসামি তানভীর সন্দেহভাজন আসামি। তিনি মূল আসামি নয়ন বন্ডের সন্ত্রাসী দল ০০৭-এর সক্রিয় সদস্য।
নয়ন বন্ড কার লোক এ বিষয়ে তিনি নিজেই বড় সাক্ষী হতে পারতেন। কিন্তু বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সেই সুযোগ আর নেই। যেহেতু বরগুনা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষই একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে, সেহেতু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সত্য উদ্ঘাটনে একটি কমিটি করতে দিতে পারে। তারা বের করবে নয়ন বন্ড কার পক্ষে কাজ করেছেন কিংবা কে বা কারা তাঁকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
পুলিশ প্রশাসনও তদন্ত করে দেখতে পারে, কারা নয়ন বন্ডের সহযোগী ছিলেন। কারা তাঁকে তৈরি করেছেন? বরগুনায় নয়ন বন্ডই একমাত্র অপরাধী নন। আরও অনেক অপরাধী আছেন। তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।