সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দিয়া খানম মিমদের বাড়ির তিন তলার ফ্ল্যাটের মূল দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে উল্টোদিকে একটি বুকসেলফ। সেই বুকসেলফের ওপরে বাঁধাই করা বড় একটি ছবি। সেই ফ্রেমে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন তিন ভাইবোন—রোকাইয়া খানম রিয়া, দিয়া খানম মিম ও রিয়াদুল ইসলাম আরাফাত। ছবি এই দৃশ্য এখন কেবলই স্থিরচিত্র। বাস্তবে এই তিনজনকে আর কখনোই একসঙ্গে দেখা যাবে না। এঘর ছাড়াও বাড়ির অন্যান্য করেও আছে দিয়ার বিভিন্ন ভঙ্গির ছবি। কেবল দিয়া আছে, তার বদলে আছে বাবা-মা আর ভাইবোনদের হৃদয়ভরা হাহাকার!
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কালশী ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে ছিল। তখন জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় মুখেই দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় পেছন থেকে আরেকটি দ্রুতগতির জাবালে নূরের বাস ওভারটেক করে সামনে যাওয়ার পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এ সময় ওই বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজিব। আর এ দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পরই দেশজুড়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে।
রবিবার (২৮ জুলাই) দিয়া খানম মিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রতিটি ঘরে দিয়ার ছবি বাঁধাই করে রাখা। কোনও ছবিতে একা দিয়ার মুখ, কোনও ছবিতে কেবল বোনের সঙ্গে, কোনও ছবিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে। ছবি দেখাতে দেখাতে বড় বোন রোকাইয়া খানম রিয়া বলেন, ‘এ বাড়ির সবকিছুতে মিমের ছোঁয়া। কিন্তু তাকে হারিয়ে আমাদের হৃদয়ে সৃষ্টি হওয়া হাহাকার তো কেউ দেখে না। এ কেবলই আমাদের ব্যথা।’
দিয়ার মা রোকসানা বেগমের ঘরে ঢুকে দেখা যায়, ‘তিনি বসে আছেন। পাশে মেয়ের ছবি।’ অসুস্থ কিনা, জানতে চাইতেই দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মেয়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন যত ঘনিয়ে এসেছে, ততই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গত একবছরে এমন কোনও দিন নেই, যেদিন দিয়ার কবরে তিনি যাননি। আসরের নামাজ পড়ে চলে যান, ফেরেন মাগরিবের পর।’
দিয়ার ছবি দেখতে দেখতে মা বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে তো এখনও কিছু হয়নি। যে সড়ক আন্দোলনের জন্য দেশে এত কিছু হইলো, তখন কত কথা শুনলাম, কিন্তু তারপরও তো কত মায়ের বুক খালি হইছে।’
দিয়ার বোন রোকাইয়া খানম রিয়া বলেন, ‘ড্রয়িং রুমের শোকেসে সাজানো রয়েছে দিয়ার আইডি কার্ডের ছবি, তার ব্যবহার করা দু’টি হাতঘড়িসহ অন্য সবকিছু। তার পোশাকগুলো থরে থরে সাজানো রয়েছে, কিছু ফেলা হয়নি।’ বলেন রিয়া বলেন, ‘আমার দেড় বছরের ছোট ছিল। কেবল সেই দেড় বছর আর গত এক বছর—এই সময়টাই আমরা একসঙ্গে নেই। নয়তো আমাদের এই বড় হওয়ার পুরোটা সময়ে আমরা দুই বোন একসঙ্গে থেকেছি। কত মানুষ বলতো, পিঠেপিঠি বোন হলে ঝগড়া হয়, মনোমালিন্য হয়। আমাদের মধ্যে কোনও দিনই সে ধরনের কোনও ঝগড়া হয়নি। আমাকে আমার সেই বোনটা একা করে চলে গেলো!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিয়া আরও বলেন, ‘এখন আর আমাদের বাড়িতে পোলাও-মাংস রান্না হয় না। কারণ পোলাও-মাংস ছিল দিয়ার প্রিয় খাবার। আমাদের বাড়িতে কোনও উৎসব হয় না। তাই উৎসবের দিনে অনেক কষ্ট হয়।’ রিয়া যখন কথা বলছিলেন, তখন পাশে বসে কাঁদছিলেন একমাত্র ভাই রিয়াদুল ইসলাম। তার কণ্ঠে অস্ফুট স্বরে ‘আপু’ শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দই শোনা যায়নি।