মঙ্গলবার , ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

ওড়িশার থানায় নারীকে শারীরিক ও যৌন হেনস্থার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে

Paris
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১১:৫৬ অপরাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশার একটা থানায় এক নারীকে শারীরিক ও যৌন হেনস্থার অভিযোগ ঘিরে সম্প্রতি তোলপাড় শুরু হয়েছে। একদল পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগের তদন্তভার দেওয়া হয়েছে হাইকোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে।

গত সপ্তাহে একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ও তার বাগদত্তার তোলা এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর তিনজন নারী কর্মীসহ চার পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযুক্ত পঞ্চম পুলিশ কর্মীকে বদলি করা হয়েছে। ওড়িশার ক্রাইম ব্রাঞ্চ এই মামলার তদন্ত শুরু করার পরই এই পদক্ষেপ নেয়া হলো।

সতর্কতা: এই প্রতিবেদনে কিছু বিবরণ পাঠকদের বিচলিত করতে পারে।

ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বরে একটা রেস্তোরাঁ চালান বছর আইনে স্নাতক বত্রিশের ওই নারী।

গত ১৫ই সেপ্টেম্বর সকালে পুলিশ তার উপর নির্যাতন চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছেন ওই নারী। সেই ঘটনার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে।

এই ভিডিও দেখা কঠিন।

হুইল চেয়ারে বসে, গলায় কলার এবং এক হাত স্লিংয়ে (হাত ভেঙে গেলে বা চোট পেলে যে ব্যাগে ঝোলানো হয়) রাখা অবস্থায় ওই নারী সাংবাদিকদের সামনে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার ভেঙে পড়ছেন।

রাত একটা নাগাদ রেস্তোরাঁ বন্ধ করার পর তিনি ও সেই সেনা কর্মকর্তা ভরতপুর থানায় গিয়েছিলেন অভিযোগ দায়ের করতে। রাস্তায় একদল লোক তাদের উত্যক্ত করেছে এই অভিযোগ জানানোর জন্যই গিয়েছিলেন তারা।

ওই নারী জানিয়েছেন দ্রুত পুলিশের টহলরত গাড়িকে ঘটনাস্থলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানান তিনি যাতে অভিযুক্তদের আটক করা যায়। তার যুক্তি ছিল অভিযুক্তরা হয়তো তখনও খুব বেশিদূর চলে যেতে পারেনি তাই পুলিশের টহলরত গাড়ি তাদের ধরতে পারবে।

তিনি বর্ণনা করেন, “আমাদের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে পুলিশ। এর বদলে তারা আমাদের গালিগালাজ করতে শুরু করে। যখন জানাই আমি আইনে স্নাতক এবং আমার অধিকার জানি, তখন আরও রেগে যায় তারা।”

তার অভিযোগ, তার সঙ্গে থাকা সেনা কর্মকর্তাকে উল্টো থানার হাজতে ঢোকানো হয়।

“আমি আপত্তি জানালে দু’জন নারী পুলিশ আমার চুল ধরে টানতে থাকে এবং মারধর শুরু করে। আমি বারবার তাদের থামার জন্য অনুরোধ করতে থাকি। কিন্তু তারা আমাকে করিডোর দিয়ে টেনে নিয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে একজন আমাকে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে।”

“আমি পাল্টা জবাব দিলে তারা আমার হাত-পা বেঁধে ঘরে আটকে রাখে,” কথা বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠছিলেন তিনি।

ওই নারী অভিযোগ জানিয়েছেন তাকে যৌন হেনস্থাও করা হয়।

“একজন পুরুষ অফিসার এসে আমার ঊর্ধ্বাঙ্গের অন্তর্বাস খুলে দেয়। এরপর আমার স্তনে লাথি মারতে শুরু করে। সকাল ছ’টার দিকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওই কক্ষে আসে।”

“সে আমার প্যান্ট টেনে নামিয়ে দেয়। এরপর তার নিজের প্যান্টও নামিয়ে ফেলে এবং আমাকে হুমকি দেয় সাহায্যের জন্য চিৎকার বন্ধ না করলে আমাকে একাধিকবার ধর্ষণের করবে।”

গত সপ্তাহে পুলিশের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, ওই সেনা কর্মকর্তা ও তার বাগদত্তা মদ্যপ অবস্থায় থানায় এসেছিলেন। কর্মকর্তার সঙ্গে থাকা নারী থানায় এসে উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন।

পুলিশের অভিযোগ ছিল, ওই নারী একজন নারী পুলিশ কর্মীকে চড় মেরেছিলেন এবং অন্য এক অফিসারকে কামড়ে দিয়েছিলেন।

এই ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং আদালতে তোলা হলে ম্যাজিস্ট্রেট তার বেল নাকচ করে দেন।

কিন্তু ঘটনার তিন দিন পর উচ্চ আদালত ওই নারীকে জামিনে মুক্তি দেয় এবং পুলিশ ও নিম্ন আদালতের সমালোচনা করে।

বিচারপতি আদিত্য কুমার মহাপাত্র বলছেন, “রেকর্ডগুলো সাবধানতার সাথে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুতর প্রকৃতির… গণতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল সমাজের ধারণার প্রেক্ষিতে তা ঘৃণ্য।”

একই সঙ্গে পুলিশের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, “গ্রেফতার করার সময় আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।”

বিচারপতি মহাপাত্র বলেন, সরকার পক্ষের আইনজীবী তাকে জানিয়েছেন, “অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে… এবং দোষ প্রমাণ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ওই নারীর জামিন নাকচ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন নিম্ন আদালত “তার বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে।”

এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর ভারতের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশের নির্মমতার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

অনেক প্রাক্তন ও কর্মরত সেনা কর্মকর্তা ওই নারীর আর্জি জানানো ভিডিও শেয়ার করে তার এই লড়াইয়ে সামিল থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। অভিযোগকারী একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা ব্রিগেডিয়ারের কন্যা।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে ওড়িশা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে একটা চিঠিও পাঠানো হয়েছে। ‘একজন কর্মরত অফিসারকে কোনও অভিযোগ ছাড়াই প্রায় ১৪ ঘণ্টা হেফাজতে রাখা হয়েছিল’ এবং ‘গুরুতর ঘটনার কারণে.. তার সম্মানহানি’ হয়েছে বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

একইসঙ্গে হেনস্থার অভিযোগ জানিয়ে সরব হওয়া নারীর হয়েও সওয়াল তোলা হয়েছে।

‘তার (সেনা কর্মকর্তার) বাগদত্তা যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের মেয়েও, তার মর্যাদা পুলিশ কর্তৃপক্ষের কারণে চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে,’ বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগকারিণী নারীর পিতা বিবিসিকে জানিয়েছেন, কীভাবে ওই রাতে মেয়েকে খুঁজে বের করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাগলের মতো চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এমনকি তাকে বা তার পরিবারকে মেয়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কেও পুলিশ কিছু জানায়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।

তিনি বলেন, “কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা জানান, আমার মেয়েকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। পরদিন বিকেলে আমাকে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়।”

তবে শেষপর্যন্ত বিচার পাওয়া নিয়ে আশাবাদী তিনি। তার কথায়, “আশা করছি আমরা ন্যায়বিচার পাব।”

ওড়িশা সরকার জানিয়েছে তারা ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সম্মান করে’ এবং ‘নারীদের মর্যাদা, সুরক্ষা এবং অধিকারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন’।

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চিত্তরঞ্জন দাশকে এই ঘটনার তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য মনোনীত করেছে রাজ্য সরকার।

ক্রাইম ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা নরেন্দ্র বেহেরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওই নারীর অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে তার বয়ান রেকর্ডও করা হয়েছে।

অন্যদিকে, এই দম্পতিকে হয়রানি করার অভিযোগে সাতজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে যারা পরে জামিনে পেয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ অভিযোগকারী নারীর পোশাক নিয়ে মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ আবার ‘পুরুষের সঙ্গে তর্ক করা এবং মদ্যপান করাকে কেন্দ্র করে তার চরিত্র’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মী নম্রতা চাড্ডা হাসপাতালে ওই নারীর সঙ্গে দেখা করেছেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “এ ধরনের ভিকটিম শেমিংয়ের (নির্যাতনের শিকারকেই দায়ী করা বা তার বিরুদ্ধে অপমানসূচক মন্তব্য করা) ঘটনা হৃদয়বিদারক।”

“ওর কাঁধে আঘাত লেগেছে, মুখে কাটা দাগ রয়েছে এবং চোখের চারপাশে ফোলাভাব রয়েছে। খুবই ট্রমাটাইজড অবস্থায় রয়েছে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তার চোখ দুটো বেশ কয়েকবার জ্বলজ্বল করে উঠল।”

“আমি তাকে বলেছি-তোমাকে সাহস দেখাতে হবে এবং সবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে। ও জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।”

মিজ চাড্ডা জানিয়েছেন, যখন কোনও নারী অভিযোগ দায়ের করেন, তখন পুলিশকে একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর’ অর্থাৎ নির্দিষ্ট পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হয়।

“ধৈর্যশীল হয়ে অভিযোগকারীর কথা শোনা তাদের কর্তব্য। কোনও নারী আক্রমণাত্মক বা উত্তেজিত হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।”

“সেক্ষেত্রে তাকে এক গ্লাস জল খেতে দিতে হবে, শান্ত করতে হবে। কিন্তু উনি (অভিযোগকারিণী) যা অভিযোগ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে মৌলিক নিয়মই মানা হয়নি।”

“তাছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট যখন প্রতিটি থানার জন্য সিসিটিভি বাধ্যতামূলক করেছে, তখন সেখানে কোনও সিসিটিভিই ছিল না কেন?” প্রশ্ন তুলেছেন মিজ চাড্ডা।

যে থানাকে নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা শুরু হয়েছে মাত্র চার মাস আগে।

মিজ চাড্ডা মনে করেন এই মামলা এই পরিমাণ দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ ওই নারীর ব্যাকগ্রাউন্ড।

“কিন্তু কেউ জানে না যে সাধারণ নারীরা যখন সাহায্য চাইতে যান তখন এই থানায় বা অন্যান্য থানাগুলিতে কী হয়।”

“আমরা আমাদের মেয়েদের বলি, বিপদে পড়লে কাছাকাছি থানায় যেতে। আমরা তাদের বলি যে এটা বাড়ির পর দ্বিতীয় নিরাপদ জায়গা। এখন তাদের আমরা কী বলব? একজন নারী এখন কোথায় যাবে?”

 

সূত্র: বিবিসি বাংলা

সর্বশেষ - আন্তর্জাতিক