আইএমএফের চেয়ে সহজ শর্তের ঋণ খুঁজছে সরকার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সহজ শর্তের ও নমনীয় সুুদ হারের বিদেশি ঋণ খুঁজছে সরকার। এ জন্য আইএমএফের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, জাইকা, জাপান ও চীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরকারের দুজন প্রতিনিধি ঢাকা সফর করে গেছেন। আইএমএফের চেয়ে উত্তম কোনো ঋণের উৎস পেলে সেখান থেকেই ঋণ নেবে সরকার। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থবিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, করোনা মহামারির রেশ কাটার আগেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিনই সংকুচিত হচ্ছে বৈশি^ক অর্থনীতি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ায় টাকার মান কমছে প্রতিদিন। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।  এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য নমনীয় বৈদেশিক ঋণ খুঁজছে সরকার।

সরকার মনে করে, সামষ্টিক অর্থনীতির ধস ঠেকাতে নমনীয় ঋণই এই মুহূর্তে বড় ভরসা। যেসব ঋণের সুদ হার খুব সামান্য হয় এবং গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যায় অন্তত ১৫ বছরের অধিক, ঋণের অর্থ ব্যবহার করা যায় নিজেদের মতো করে, সাধারণত এসব ঋণকে নমনীয় বলা হয়। এই মুহূর্তে সংকট উত্তরণে এ ধরনের ঋণই হতে পারে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গত ২৪ জুলাই চিঠি দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রস্তাব সংস্থাটির বোর্ড সভায় ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে। অবশ্য সংস্থাটি ইতোমধ্যে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা ও সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ জন্য সংস্থাটি বাংলাদেশকে এ ঋণ দিতে সম্মত। তারপরও বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও ঋণ প্রস্তাব বিশ্লেষণ করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আগামী মাসের শুরুতে। যদিও এই সফরের সূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ঋণের এই প্রস্তাব নিয়ে মূল আলোচনা শুরুর আগেই প্রাথমিক কিছু শর্তারোপ করা হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড মাত্রায় বাড়ানো হয়েছে। এখন চলছে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তুতি। আবার বিদ্যমান থাকা ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদ হার ৬/৯ শতাংশ তুলে দেওয়ার চাপও রয়েছে সংস্থাটির। এ ছাড়া ব্যাংক ও সামগ্রিক আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ব্যাপারে আইএমএফের শক্ত অবস্থান রয়েছে। এসব শর্তের বাইরেও নতুন কিছু শর্তারোপের বিষয়েও দর কষাকষি হবে আগামী মাসে।

জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধির বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। সব ধরনের পরিবহন খরচ ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়তে শুরু করেছে। এরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ জন্য আইএমএফের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, জাইকা, জাপান, চীন সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের এখন সবচেয়ে বড় সংকট হলো ডলার সংকট। আমদানি ব্যয় কমাতে না পারলে এ সংকট আরও বাড়বে। সরকার খরচ ও ভর্তুকি কমাতে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর। এতে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে। আবার সরকারের হাতে তেমন কোনো বিকল্পও নেই। তবে এক লাফে এতটা না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ালে মানুষের মানিয়ে নিতে সহজ হতো বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

অর্থবিভাগ বলছে, আইএমএফের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা অনুযায়ী যেসব শর্তারোপ করা হয়েছে সেগুলো হলো- (ক) বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ সার্বিক বাজেট ভর্তুকি কমিয়ে আনা, ভর্তুকির তথ্য আইএমএফকে প্রদান করতে হবে। (খ) খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, ব্যাংকসহ সমগ্র আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে। কার্যকর থাকা ব্যাংকের সুদের ৬/৯ হার পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। (গ) কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে। (ঘ) প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অতিমূল্যায়ন বন্ধ করতে হবে। মেগা প্রকল্পসহ সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। (ঙ) বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবে না। বিশেষ করে ডলারের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ না করে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। তবে এগুলো চূড়ান্ত নয়। শর্ত আরও বাড়তে পারে। অর্থবিভাগ আরও জানায়, ঋণ পেতে আইএমএফের প্রতিনিধি দলকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বহুজাতিক এ ঋণদাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঋণের পরিমাণ ও শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করা হবে। এ ছাড়া প্রতিনিধি দলটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে পর্যালোচনা করবে। এরপর সেই পর্যালোচনা প্রতিবেদন আইএমএফের বোর্ড সভায় তোলা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এর আগে গত জুনে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে গেছে। সে সময় এই ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। সে দলে নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দ।

 

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন