সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :
বাংলাদেশের নিকটস্বজন আসাম, উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থলবেষ্টিত রাজ্য। আসামের ভাষা অসমিয়া, রাজধানী দিসপুর, গুয়াহাটি। আসামে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাঙালির বসবাস।
পর্বতবাহুল্যবশত ভূমি অসমতল (অসমভূমি) হওয়ায় অসমের অপভ্রংশ ‘আসাম’ নামে পরিচিত।
অন্য মতে, ‘অসম’ প্রতিপত্তিসম্পন্ন আহম জাতির জনপদের নাম আসাম।
হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত আসামে আছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা এবং উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। ভারতের ছয়টি রাজ্য—অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় পরিবেষ্টিত আসামের আন্তর্জাতিক সীমান্ত প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভুটান এবং দূরবর্তী দেশ চীন ও মায়ানমার। একসময় বাংলাদেশের সিলেটের অংশ ছিল আসামের করিমগঞ্জ জেলা।
মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান তাঁর পীর সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আসামে গিয়ে গণ-অধিকারের আওয়াজ উচ্চকিত করেন। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ি জেলার ব্রহ্মপুত্রের ভাসানচরে কৃষক সম্মেলনে জ্বালাময়ী বক্তব্যের জন্য তাঁর নাম ‘ভাসানির মাওলানা’, মওলানা ভাসানী হয়।
বহু ধর্মাচারের বহুজাতিক আসামের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম ইসলাম। ২০২১-এর জনশুমারি অনুযায়ী, মুসলমান অন্তত এক কোটি ৪০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি, ফলে আসাম ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল।
আসামে ৩৫টি জেলার মধ্যে প্রায় ১১টিতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আছে অত্যন্ত জনবহুল জেলা চারটি। আসামের প্রধান ধর্ম হিন্দু ৫৭.৯ শতাংশ, খ্রিস্টান ধর্ম ৩.৭ শতাংশ, শিখ ১ শতাংশ, বৌদ্ধ ইত্যাদি।
অসমিয়া মুসলমানদের চারটি উপগোষ্ঠী : দেশি, মারিয়া, গৌড়িয়া ও সৈয়দ। তাদের মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠী পরাজিত মোগল সৈন্যদের বংশধারার, যারা অসমিয়াদের বিয়ে করে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করেন। সৈয়দরা নিজেদের মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর মনে করে।
আসামে প্রথম নওমুসলিমদের একজন ছিলেন আলি মেচ, তিনি মেচ উপজাতির প্রধান। দেশি বা জুলারা কোচ, মেচ, রাভা, বোড়ো থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত আদিবাসী বংশধারা। তারা আলি মেচকে তাদের জাতির পিতা বিবেচনা করেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মালিক ইখতিয়ার উদ্দিন ইউজবক ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে আসামের কিছু অঞ্চল সংক্ষিপ্তভাবে দখলে নেন। তিনি আসামে খুতবা ও জুমার নামাজ চালু করেন।
মোগল আমলে ইসলাম খাঁ আসাম অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এবং এক পর্যায়ে বাংলার সুবাদার শাহ সুজার নামানুসারে কামরূপের নাম হয় সুজাবাদ।
সুজাবাদের ষষ্ঠ ফৌজদার মির লুত্ফুল্লাহ খান বাহাদুর শিরাজি ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে কোচ হাজোতে একটি পাহাড়ের চূড়ায় মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ অঙ্গনে ইরাকের যুবরাজ গিয়াসউদ্দিন আউলিয়ার মাজার রয়েছে।
২০১১ সালের হিসাবে আসামের জনসংখ্যা তিন কোটি ১২ লাখ পাঁচ হাজার ৫৬৬।
আসামের ভাষাসমূহ: অসমিয়া (৪৮.৩৮ শতাংশ), বাংলা (২৮.৯২ শতাংশ), বোড়ো (৪.৫৪ শতাংশ), হিন্দি (৪.৩১), সাদরি (২.২৯), মিশিং (১.৯৮), নেপালি (১.৯১), কার্বি (১.৬৪), ওড়িয়া (০.৭০), সাঁওতালি (০.৬৮), গারো (০.৫৫), মণিপুরি (০.৫৪), ডিমাসা (০.৪২), রাভা (০.৩৩), অন্যান্য (২.৯১)।
বাংলার সঙ্গে সাদৃশ্যের কারণে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের বাংলা আসামের আদালত ও রাজকার্যের ভাষায় পরিণত হয়েছিল। তবে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে অসমিয়া ভাষাই বাংলার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আসামের প্রধান উৎসবগুলো হলো বিহু, দুর্গাপূজা, কালীপূজা, দীপান্বিতা, কামাখ্যা মেলা, মে-ডাম-মে-ফি, ঈদ, মহররম, শঙ্করদেবের জন্মোৎসব, বৈচাগু, বাইখু, রংকের, অম্বুবাচি মেলা, জোনবিল মেলা ইত্যাদি।
অসমিয়াদের প্রধান উৎসব হলো বিহু।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে অসমিয়ারা বিহু পালন করে। বিহু তিনটি : ব’হাগ (ঙালি) বিহু, মাঘ (ভোগালি) বিহু আর কাতি (কঙালি) বিহু।
পানবাড়ি মসজিদ বা রাঙামাটি মসজিদ আসামের ধুবড়ি জেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। এটি আসামের প্রথম মসজিদ। ১৪৯৩-১৫১৯ সালের মধ্যে বঙ্গের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহ কামতাপুর বিজয় উদ্যানে এ মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। অন্যমতে বঙ্গের নবাব মীরজুমলা আসাম আক্রমণকালে ১৬৬২ সালে মসজিদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদে সুলতানি আমলের ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায়।
আসামের কাছাড় জেলার প্রধান মসজিদের দোতলায় লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন মসজিদ কমিটি। বারাক উপত্যকায় আর কোনো মসজিদে লাইব্রেরি নেই। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মসজিদের লাইব্রেরির যাত্রা ২০১২ খ্রিস্টাব্দে। ধর্ম দর্শনে মানুষকে আগ্রহী করতে ১২টি আলমারিতে শুধু কোরআন, হাদিস ও ইসলামী বই নয়, বাইবেল, বেদ, উপনিষদসহ তিন শতাধিক অন্য বই আছে লাইব্রেরিতে। আছে রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী এবং রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্রের বইও।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন