সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বলা চলে ভূমিধস জয় পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার দ্বিতীয় মেয়াদে (যদিও বিরতি দিয়ে) হোয়াইট হাউসে ফেরা রাজসিকই হয়েছে। তার দল রিপাবলিকান পার্টি মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বড় ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, নিম্ন কক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পথে এবং প্রাদেশিক পরিষদেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ ভেদের বিরুদ্ধে বিশ্বকে সবক দেওয়া মার্কিনিদের একাংশ এবার কমলা হ্যারিসকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। আড়াইশ বছরের বন্ধ্যত্ব ঘুচানোর প্রতীতী ছিল তাদের হৃদয়ের গহীনে। কিন্তু সেই আকাঙক্ষা আর পূরণ হলো কই?
এখন পর্যন্ত যে ফল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে— ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫৩৮ টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে পেয়েছেন ৩০১টি। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোর্ক্যাট দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৬ টি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফল নির্ধারক ৭ টি সুইং (দোদুল্যমান) স্টেটের মধ্যে ইতোমধ্যে ৬টিতেই জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আজ নেভাদাও জিতে ‘উইনার টেকস অল নীতি’ অনুযায়ী রাজ্যের ৬ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সবকটি বগলদাবা করেছেন ট্রাম্প। এদিকে ফল ঘোষণার বাকি একমাত্র রাজ্য অ্যারিজোনায়ও এগিয়ে রয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজের তথ্যানুসায়ী, এখন পর্যন্ত যা ব্যালট গণনা হয়েছে সেখানে ৫২.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। সেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা হতে দেরি হলেও, মনে করা হচ্ছে অ্যারিজোনাতেও জয় পাবেন ট্রাম্প। এটিতে জিতে গেলে ট্রাম্পের ইলেকটোরাল ভোট হবে ৩১২। এর অর্থ হচ্ছে ট্রাম্প ২০২৪ এর নির্বাচনে সুইং স্টেটের সবগুলোর একচ্ছত্র অধিপতি; ৯৩ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের একটিতেও ভাগ বসাতে পারেননি কমলা হ্যারিস।
২০১৬ সালে ইলেকটোরাল কলেজে জয় পেলেও পপুলার ভোটে হেরেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার ইলেকটোরাল-পপুলার উভয় ক্ষেত্রে এগিয়ে থেকেই জয় পেয়েছেন। বিবিসির খবর বলছে, ২৪ কোটি ৪০ লাখ ভোটারের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭ কোটি ৩৪ লাখ ২৩ হাজার ৪২৯ ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। আর প্রতিদ্বন্দ্বী হ্যারিস তার চেয়ে প্রায় ৪০ কোটি ভোট কম পেয়েছেন। তার ভোট সংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লাখ ৯২ হাজার ২১৬ ভোট। ট্রাম্প ও হ্যারিসের ভোটের অনুপাত যথাক্রমে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ। বাকি রাজ্যের ফল ঘোষণা হলে ট্রাম্পের ভোট আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনি বাইডেনের রেকর্ড ভাঙার সুযোগও পেয়ে যেতে পারেন। সর্বশেষ ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোর্ক্যাট জো বাইডেন আট কোটি ১২ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। এর বিপরীতে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছিলেন সাত কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোট।
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপে দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হলেও আগের দুই নির্বাচনের মতো লড়াই হয়নি এবার। ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর প্রথম থেকেই এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ সব জায়গায়ই ট্রাম্পের দলের জয়জয়কার। অন্যদিকে রণেভঙ্গে দিয়েছেন বেচারি কমলা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল সিনেটে ৫২ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে; ডেমোর্ক্যাটরা পেয়েছে ৪৪ আসন। নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্প ২১১ আসন পেয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠতার পথে রয়েছেন, আর হ্যারিস পেয়েছেন ২০০ আসন। এখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ২১৮ আসন প্রয়োজন হয়; এখন ফল ঘোষণার বাকি ২৪ টিতে। গভর্নরেও এগিয়ে রিপাবলিকানরা। ট্রাম্পের দল পেয়েছে ২৭ ও হ্যারিসের দল ২৩।
১৭৭৬ সালে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্র। এর পর ২৪৮ বছর পার হয়েছে। দেশটিতে বিভিন্ন সেক্টরে নারীর ক্ষমতায়ন হলেও এখনও কোনো নারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। এমনকি স্বাধীনতার প্রায় দুইশ’ বছর পর একজন নারী কেবল প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন। সেটি ১৯৬৪ সালে; মার্গারেট চেস স্মিথ। এরপর বড় ফারাক।
প্রায় অর্ধশতাব্দী পর আবার নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পান যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা। ২০১৬ সালে ডেমোর্ক্যাট দলের হিলারি ক্লিনটন প্রার্থী হন। সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে জয়ী করতে পারেননি সমর্থকরা। পপুলার ভোটে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও ইলেকটোরাল কলেজের ফাঁদে আটকা পড়েন ক্লিনটনপত্নী। সেই নির্বাচনে জয় পান ২০২৪ এ ইতিহাস সৃষ্টি করা ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই নির্বাচনে দেখা যায় ট্রাম্প পুরুষ ভোট পান ৫২ শতাংশ আর হিলারি পান ৪১ শতাংশ। এবারও মার্কিন নারীবাদীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল আবারও। কমলা হ্যারিস ব্যাপক আশা জাগিয়েও হোয়াইট হাউসের দৌঁড়ে ছিটকে পড়লেন।
এবারও পুরুষ ভোটারদের ভোট বেশি গেছে ট্রাম্পের বাকসে। সংবাদ সংস্থা এনবিসির এক্সিট পোল বলেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালে ৫১ শতাংশ পুরুষ ভোট পেয়েছিলেন, যা এবারের নির্বাচনে ৫৪ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যা চমক সৃষ্টি করেছে তা হলো, ১৮-২৯ বছর বয়সি তরুণ ভোটারদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ পুরুষ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন; যা সাধারণত বামপন্থি হওয়া তরুণদের চিত্রকে ভেঙে দিয়েছে।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ট্যামি ভিজিল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যেই প্রচুর নীরব লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে। ট্রাম্পের প্রচারণা জনগণকে তাদের সবচেয়ে খারাপ প্ররোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের বিভেদকে আলিঙ্গন করার অনুমতি দিয়েছে।
উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানী ক্যাথলিন ডোলান বলেন, ‘জো রোগান এক্সপেরিয়েন্স’ পডকাস্টে ট্রাম্পের উপস্থিতি যুবকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছিল, যাতে তারা ভোটে অংশগ্রহণ করেন। এই পডকাস্টের শ্রোতাদের মধ্যে অধিকাংশই যুবক এবং পুরুষ ছিল।
ট্রাম্পের জয়ের তার শিবিরে উল্লাস বইছে। অন্যদিকে কমলা হ্যারিসের দল ডেমোর্ক্যাট শিবির পরাজয়ের সুলোক সন্ধান শুরু করেছে। ট্রাম্পের জয় ও কমলার পরাজয়ের হাজারও কারণ থাকতে পারে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে নির্মোহভাবে সবগুলো কারণ ভেদ করে আনা সহজ কাজ নয়। তবে মোটাদাগে বলা যায়—কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের নেপথ্যে ডেমোর্ক্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতা কম দায়ী নয়। অর্থনীতির ধমনিতে রক্ত সঞ্চার ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে গত চার বছরে বাইডেন প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমেরিকার স্বপ্নের ইউনিপোলার বিশ্ব ব্যবস্থায় সারা দুনিয়ায় নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে পারেননি বাইডেন। তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পটভূমি না বুঝে বহির্বিশ্বের যুদ্ধকে গুরুত্ব দিয়ে বেশুমার অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে নিজ দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনুনমেয় চরিত্র ভ্লাদিমির পুতিন, চির শত্রু ইরান ও উত্তর কোরিয়ার আকাঙক্ষার লাগাম টেনে ধরতে পারেননি বাইডেন। সেই সঙ্গে ইসরাইলি লবি তাকে পেয়ে বসেছিল; যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না ডেমোর্ক্যাট প্রশাসনের। বাইডেন প্রশাসনের রানিং মেট হওয়ায় কমলা হ্যারিস এই দায় এড়াতে পারেননি। নির্বাচন পূর্ব সংবাদ সম্মেলন ও প্রচারে এসব ব্যর্থতার সদুত্তর দিতে পারেননি হ্যারিস।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হত্যাচেষ্টা তথা তার প্রচারের সময় গুলি তাকে সহানুভূতি এনে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে নিজেদের পাশে পেতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পেছরে বড় অর্থ লগ্নি করেছে ইসরাইল। ডোনাল্ড ট্রাম্প পাশে পেয়েছেন মুসলিম, লাতিনো, আফ্রিকান ও ইহুদী গ্রুপগুলো। অন্যদিকে ডেমোর্ক্যাটরা আমেরিকার জনগণের পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি, অসম বাণিজ্য, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, ইউক্রেন-ইসরাইলকে ব্লাংক চেক দিয়ে নিজেদের অর্থনীতির বারোটা বাজানোসহ নানা কারণে জনমত ডেমোর্ক্যাটদের বিপক্ষে চলে গেছে।
‘ভোটের আগেই হেরে যান কমলা’
২০২২ সালে নিউইয়র্ক টাইমস একটি জরিপ করেছিল। সেখানে দেখা গেছে, জো বাইডেন আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হোন—এমন মত দিয়েছিল ২৬ শতাংশ ডেমোর্ক্যাট। জরিপে অংশ নেওয়া চারজনের ৩ জনই নতুন নেতা বেছে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিল। ওই বছর মধ্যবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ডেমোর্ক্যাট পার্টি বাইডেনকেই ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত জুনে ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে হেরে যাওয়ার নির্বাচনি দৌড় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন বাইডেন। এরপর লাইম লাইটে আসেন কমলা হ্যারিস। তিনি মাত্র ৪ মাস সময় পান নির্বাচনি মাঠ তৈরি করার। যদিও পার্টির হেভিওয়েট নেতা বারাক ওবামা, মিশেল ওবামা হ্যারিসের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। প্রাইমারি ছাড়াই তিনি মনোনয়ন পেয়ে যান। এর মানে হচ্ছে-ডেমোর্ক্যাট দলে আর কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যোগ্য ছিল কিনা সেটি পরখ করার সুযোগ পায়নি দলটির নেতাকর্মীরা।
একজন অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের র্যাটিং যখন ৪০ এ নেমে আসে তখন ক্যাম্পেইন শুরু করেন কমলা হ্যারিস। বাইডেনের বিপক্ষ যে জনমত চলে গিয়েছিল সেটিকে কাটিয়ে নিজের পক্ষে আনতে নির্বাচনের আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন কমলা। টেলিভিশন টক শো-গুলোতে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, বাইডেনের কাছ থেকে আপনার অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি আলাদা হবে কীভাবে, সেটির সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি কমলা।
যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি কোভিডের সময়ের চেয়েও খারাপ অবস্থানে চলে গিয়েছিল বাইডেনের সময়ে। কমলা হ্যারিস সেটি বদলাতে পারবেন—এমন কোনো আশা জাগাতে পারেননি আমেরিকানদের মধ্যে। তারা ধরে নিয়েছে-কমলা হ্যারিস বাইডেনেরই লিগ্যাসি বয়ে বেড়াবেন। তিনিও বাইডেনের মতো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, অবৈধ সীমান্ত পারাপার বাড়বে।
আরব মুসলিমদের সমর্থন হারানো
গাজা-লেবাননে ইসরাইলের যুদ্ধে নি:শর্ত সমর্থন দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এ কারণে ডেমোর্ক্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের বিপক্ষে চলে আরব মুসলিমরা। ভোটে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে আরব আমেরিকান অধ্যুষিত সবচেয়ে বড় রাজ্য মিশিগানে ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৭ শতাংশ ভোট। আর হ্যারিস পেয়েছেন মাত্র ২৮ শতাংশ ভোট।
এবারের মুসলিম ও আরব আমেরিকানরা দুই দশকের ডেমোর্ক্যাটিক আনুগত্য থেকে বেরিয়ে এসে অধিকাংশ ভোট ট্রাম্প বা তৃতীয় দলের প্রার্থীদের দিয়েছেন। গাজার যুদ্ধ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের নীতি নিয়ে ক্ষোভের কারণে এই দলত্যাগ ঘটেছে, যা ট্রাম্পকে জয়ী হতে সাহায্য করেছে। কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) এক্সিট পোল অনুযায়ী, মুসলিম ভোটারদের অর্ধেকেরও কম কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করেছেন।
মুসলিম ভোটারদের বেশিরভাগই তৃতীয় দলের প্রার্থী বা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন এবং এটি গত ২০ বছরে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম তিন প্রার্থীকে সমর্থন করার ঘটনা বলে। সিএআইআরের সরকার বিষয়ক পরিচালক রবার্ট ম্যাককো বলেছেনন, এদের অধিকাংশই তৃতীয় দলের প্রার্থী (গ্রিন পার্টি) বা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাককো এ কথা বলেন।
আরব আমেরিকান ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট জেমস জগবি বলেছেন, আরব আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে মুসলিম ভোট রদবদলের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল। এরা দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের (২ থেকে ১) সমর্থন করে এসেছিল।
জগবি ভিওএ-কে বলেন, ‘তারপর এই নির্বাচন এল যেখানে গাজা একটা প্রভাব ফেলেছে এবং এই সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিপুল পরিমাণে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল; আমি ভাবতেই পারিনি এটা এতটা প্রভাব ফেলবে। তারা গাজায় যা ঘটতে দেখেছে তা তাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ৩৭ লাখ আরব আমেরিকান রয়েছেন যাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান এবং একই সংখ্যক মুসলিম আমেরিকানও রয়েছেন। মিশিগানে আরবদের শক্ত ঘাঁটগুলি হল ডিয়ারবোর্ন, ডিয়ারবোর্ন হাইটস ও হ্যামট্রামাক। সেখানে ভোটারদের এই বিদ্রোহ সবচেয়ে জোরালো।
ডিয়ারবোর্নের বাসিন্দাদের ৫৫ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্য-বংশোদ্ভূত। ট্রাম্প এখানে ৪২ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। চার বছর আগে তিনি এই অঞ্চলে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। হ্যারিস মাত্র ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, অথচ এই জনগোষ্ঠী চার বছর আগে তাদের ভোটের প্রায় ৭০ শতাংশই দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মুসলিম সংখ্যাগুরু শহর হ্যামট্রামাকে ট্রাম্প মোট ভোটের ৪৩ শতাংশ পেয়েছেন। তিনি ২০২০ সালে এই শহর থেকে মাত্র ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। হ্যারিস পেয়েছেন ৪৬ শতাংশ ভোট, যেখানে চার বছর আগে বাইডেন পেয়েছিলেন ৮৫ শতাংশ ভোট। গ্রিন পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইন গাজায় ইসরাইলি যুদ্ধের কঠোর সমালোচক। তিনি এই দুই শহরে ২০ শতাংশের কম ভোট টানতে পেরেছেন।
কৃষ্ণাঙ্গ ফ্যাক্টর
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সব সময়ই কালো ডেমোর্ক্যাটদের পক্ষে থাকে। কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ভোট ব্যাংক বলা চলে। ১৯৩২ সালে ফ্রাংলিন ডি রুজভেল্টের সময় থেকেই সংস্কৃতি সেখানে। গত বছর গ্যালপের এক জরিপে দেখা গেছে-ডেমোর্ক্যাটদের পক্ষে কৃষ্ণাঙ্গদের জনমত ৭৭ শতাংশ থেকে ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০০ সালে জর্জের বুশের সময়ের পর এই নির্বাচনে ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গদের এতো বেশি সমর্থন পেলেন। এসোসিয়েট প্রেসের এক্সিট পোল বলছে, ২০২৪ এর নির্বাচনে ট্রাম্প ২০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ভোট পেয়েছেন। ২০১৬ নির্বাচনে ট্রাম্প যেখানে মাত্র ৮ শতাংশ কমিউনিটি ভোট পেয়েছিলেন এবার সেটি বেড়ে ১৩ শতাংশ হয়েছে।
লাতিন আমেরিকানদের সমর্থন হারানো
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী লাতিন আমেরিকানদের সমর্থন হারিয়েছেন কমলা হ্যারিস। এক্সিট পোল বলছে, লাতিন আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন বেড়েছে ১৪ শতাংশ ২০১৬ সালের নির্বাচনের তুলনায়। লাতিনো ভোটাররা বাইডেনের সময়ের ভঙ্গুর অর্থনীতি ভোটের সময়ে সামনে এনেছে। বাইডেন-কমলা প্রশাসনের সময়ে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, স্বাস্থ্যসেবায় খরচ বেড়ে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ট্রাম্পকে বেছে নিয়েছেন।
৫৪ শতাংশ পুরুষ ভোট পেয়েছেন ট্রাম্পের ঝুলিতে
প্রচারে গর্ভপাতের অধিকারকে সামনে রেখে কমলা হ্যারিস ভেবেছিলেন নারী ভোটারদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য একটি বিজয়ী সূত্র খুঁজে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু আমেরিকান পুরুষ বিশেষ করে তরুণদের ওপর আস্থা রেখে মার্কিন নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংবাদ সংস্থা এনবিসির এক্সিট পোল অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালে ৫১ শতাংশ পুরুষ ভোট পেয়েছিলেন, যা এবারের নির্বাচনে ৫৪ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যা চমক সৃষ্টি করেছে তা হলো, ১৮-২৯ বছর বয়সি তরুণ ভোটারদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ পুরুষ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন; যা সাধারণত বামপন্থি হওয়া তরুণদের চিত্রকে ভেঙে দিয়েছে।
ট্রাম্পের লাভ হচ্ছে- এমন একটি লিঙ্গ বিভাজন তৈরি হওয়ার কারণে যা তরুণ জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলছে। ২৯ বছরের নিচে নারীদের মধ্যে হারিস-ট্রাম্পের সমীকরণ ছিল ৬১-৩৭। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ট্যামি ভিজিল এএফপি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যেই প্রচুর নীরব লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে। ট্রাম্পের প্রচারণা জনগণকে তাদের সবচেয়ে খারাপ প্ররোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের বিভেদকে আলিঙ্গন করার অনুমতি দিয়েছে। ‘কঠিন’ ট্রাম্পকে ‘নেতা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্পেন্সার থমাস, যিনি হ্যারিসকে ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেন, তার অনেক সহপাঠী যারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, তাদের মনে প্রধানত অর্থনীতি ছিল। তারা বেশি মনোযোগ দিয়েছিল অর্থনৈতিক নীতিমালা এবং সেই জাতীয় বিষয়গুলোর প্রতি, আসলে গর্ভপাত অধিকার নিয়ে নয়।
নারী ভোট ব্যাংক হারিয়েছেন হ্যারিস
এক্সিট পোল বলছে, কমলা হ্যারিস এবার ৫৪ শতাংশ নারী ভোট পেয়েছেন। আগের নির্বাচনে বাইডেনের পক্ষে সায় দিয়েছিল ৫৭ শতাংশ মার্কিন নারী। গর্ভপাত অধিকার, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাস্টিক অর্থনীতি এসবকে সামনে রেখে নারীরা ট্রাম্পের দিকে ঝুকেছে।
ব্লু -ওয়াল ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারানো
মার্কিন নির্বাচনে ব্লু ওয়াল বা নীল প্রাচীর বলতে ১৮টি মার্কিন অঙ্গরাজ্য এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়াকে (ডিসি) বোঝায়। এই ব্লু ওয়াল জয় করতে হ্যারিস এবং ট্রাম্প দুই প্রার্থীই তাদের প্রচারে যথেষ্ট সময় খরচ করেছেন। তবে ইতিহাস বলছে এগুলো কয়েক দশক ধরে ডেমোর্ক্যাটদের শক্ত ঘাঁটি ছিল।
তবে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তখন এই তথাকথিত নীল প্রাচীরের অন্তর্গত তিনটি এলাকায় ডেমোর্ক্যাটদের ভোটব্যাংকে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০২০ সালে জো বাইডেন সেই এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।
নীল প্রাচীরের এই ধারণার নেপথ্যে থাকা ১৮টি প্রদেশ হল – ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক, ইলিনয়েস, পেনসিলভেনিয়া, নিউ জার্সি, ম্যাসাচুসেটস, মিশিগান, ওয়াশিংটন, উইসকনসিন, মেরিল্যান্ড, মিনেসোটা, কানেক্টিকাট, ওরেগন, মাইনে, হাওয়াই, ডেলাওয়ার, রোহডে দ্বীপ এবং ভারমন্ট।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী ‘ব্লু -ওয়াল’ খ্যাত ডেমোক্রেট-শাসিত রাজ্যগুলোর ওপরেই নির্ভরশীল ছিল। পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন এবং মিশিগানের মতো রাজ্যগুলোতে বিজয়ই তাকে ফের হোয়াইট হাউজে পৌঁছানোর জন্য সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প আবারও এই রাজ্যগুলোতে জয়ী হয়েছেন। যা হ্যারিসের পরাজয়ের কারণ হিসাবে ধরা হচ্ছে। পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্প ২ শতাংশ ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন এবং ১৯ ইলেক্টোরাল ভোট অর্জন করেন। উইসকনসিনে ট্রাম্প ০.৯ শতাংশ ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে ১০ ইলেক্টোরাল ভোট অর্জন করেন। মিশিগানে ট্রাম্প ১.৪ শতাংশ ব্যবধানে বিজয়ী হন এবং ১৫ ইলেক্টোরাল ভোট অর্জন করেন।
তথ্যসূত্র: আলজাজিরা, মিডলইস্ট আই, বিবিসি, সিএনএন।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।
সূত্র: যুগান্তর