সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
শুক্রবার সকালে জাতীয় পার্টির বনানী অফিসে করা এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন তিনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সন্ধ্যার দিকে একটি মিছিল জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে এলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রথমে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
পরে জাতীয় পার্টিকে ‘জাতীয় বেইমান’ উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এর পরপরই আরও একটি মিছিল এসে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে এবং স্প্রে দিয়ে দেয়ালে ‘জাতীয় টয়লেট’ লিখে রাখা হয়েছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলছেন, ব্যক্তির কাজের দায় প্ল্যাটফর্ম নেবে না। জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে মিছিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজস্ব ফোরামে আলাপ না হওয়ার কথা জানাচ্ছে সদস্য সচিব আরিফ সোহেলও।
সরেজমিন যা দেখা গেল
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাঁচতলা ভবনটির সামনে টাঙানো দলীয় ব্যানারের পোড়া অংশ এখনও ঝুলছে।
ঠিক তার নিচেই দেয়ালের গায়ে স্প্রে দিয়ে বড় বড় করে লেখা হয়েছে ‘জাতীয় টয়লেট’, ‘পাবলিক টয়লেট’, ‘দালাল’ এবং ‘এখানে ময়লা ফেলুন’- এর মতো শব্দ।
নিচতলায় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ম্যুরাল এবং দলটির লোগো লাগানো দেয়ালে চালানো হয়েছে ভাঙচুর।
বিশেষ করে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে ম্যুরালের মুখের অংশটি।
শুক্রবার দুপুর একটার দিকে ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে এমনটাই দেখা যায়।
এছাড়াও আগুনে পুরোপুরি পুড়ে গেছে ভবনটির নিচতলা। সেখানে জড়ো হয়ে থাকতে দেখা যায় কিছু মানুষকে।
তবে তাদের মধ্যে কেউই কথা বলতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে, সেখানকার একটি দোকানে কর্মরত এক ব্যক্তি জানান, গতকাল সন্ধ্যার দিকে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে একটি মিছিল আসে।
২০ থেকে ৩০ জনের সেই মিছিলে থেকে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয় এবং ইটপাটকেল ছোড়া হয়।
পরে কার্যালয়ের ভেতর থেকে দলটির নেতা-কর্মীরা বেরিয়ে এসে মিছিলকারীদের হামলা করে।
প্রাথমিকভাবে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যায়। তবে পরে আরও বেশি মানুষ নিয়ে তারা সেখানে আসে এবং ভবনটিতে হামলা করে ও অগ্নিসংযোগ চালায়।
প্রথমে পুলিশ ও পরে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি শান্ত করে। শুক্রবার দুপুরেও পুলিশের একটি ইউনিটকে ভবনটির সামনে টহল দিতে দেখা যায়।
বিবিসি বাংলার খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করুন।
কেন এই হামলা?
চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ দলের নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিতে দোসরা নভেম্বর রাজধানীতে সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় জাতীয় পার্টি।
সূত্র বলছে, বৃহস্পতিবার এই খবর আসার পর কয়েকজনকে নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা জাতীয় পার্টি কার্যালয় অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা’র ব্যানারে করা মশাল মিছিলটি জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের কাছাকাছি গেলে সেখানে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিছিলে থাকা লোকজনের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
দুই পক্ষই দাবি করেন, আগে তাদের ওপর হামলা হয়েছে এবং তারা হামলা প্রতিহতের চেষ্টা করেছেন।
প্রথমে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হলেও পরে আরও মানুষ সেখানে সমবেত হয় এবং ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
জাতীয় পার্টির উদ্দেশে তিনি লেখেন, “জাতীয় বেইমান এই জাতীয় পার্টি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিজয়নগরে আমাদের ভাইদের পিটিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। এবার এই জাতীয় বেইমানদের উৎখাত নিশ্চিত।”
এর প্রায় ২০ মিনিট পর তিনি আরেকটি স্ট্যাটাসে লেখেন, “রাজু ভাস্কর্য থেকে ৮.৩০ এ মিছিল নিয়ে আমরা বিজয়নগরে মুভ করবো। জাতীয় বেইমানদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে”।
আর তারপরই জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
তিনি বলেন, “গতকাল ছাত্র জনতার নামে কিছু মানুষ এসে আমাদের পার্টি অফিসে সন্ধ্যার পরে হামলা করে।”
কর্মীরা হামলা প্রতিহত করার পর আবারও ‘সংঘবদ্ধভাবে এসে পার্টি অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালিয়েছে’ বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
“আমরা যতটুকু জানি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তারা রাজু ভাস্কর্য থেকে ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর চালান,” বলেন মি. কাদের।
এর আগে ২৯শে অক্টোবর রাত সাড়ে নয়টার দিকে কাকরাইলে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে “মশিউর, ইসমাইল ও আনোয়ারের নেতৃত্ব কিছু মানুষ এসে হামলা ও ভাঙচুর করে” বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি।
মি. কাদের বলেন, “বর্তমানে তারা নাগরিক কমিটিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন বলে জানা যায়।”
এ নিয়ে কথা বলতে নাগরিক কমিটির একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, ফোরামে আলাপ হয়নি’
জাতীয় পার্টির অফিসে হামলার ঘটনাটি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত কোনো সিদ্ধান্ত নয়’ বলে জানিয়েছেন প্ল্যাটফর্মটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা।
বরং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেই এমনটা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মুখপাত্র বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চায় দেশের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসুক এবং সরকার সেটা নিশ্চিত করুক।”
“আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এড়িয়ে শিক্ষার্থী বা সাধারণ মানুষকে দিয়ে যদি সমস্যা সমাধান করতে চাই, তাহলে দিনশেষে বিভিন্ন গ্রুপের সুবিধা নেয়ার সুযোগ তৈরি হবে,” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এক্ষেত্রে “নিজেদের মধ্যে কথা বলে এই ধরনের ব্যক্তিগত কন্ডাক্ট যাতে কেউ করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে” বলেও জানান এই সমন্বয়ক।
প্লাটফর্মটির সদস্য সচিব আরিফ সোহেলও বলেন, “নিজেদের ফোরামে আলাপ-আলোচনার আগেই তাৎক্ষণিকভাবে হামলার প্রতিবাদে মিছিলটি হয়ে গেছে। মিছিল করার অধিকার সবারই আছে। মিছিল ডাকা মানেই ভাঙচুর করতে বলা না। ছাত্রদের দ্বারা অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর হয়নি।”
তবে বিষয়গুলো দায়িত্বশীল জায়গা থেকে পরিষ্কার করা দরকার উল্লেখ করে মি. সোহেল বলছেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফোরামে সেটা ডিসিশন হয়নি। যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছে রেসপন্সিবিলিটি চলে আসে, উইলিংলি অর আনউইলিংলি, সেক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে এবং যারা যারা সংশ্লিষ্ট তাদের জবাবদিহি করবে।”
এদিকে, এই ধরনের কাজের ক্ষেত্রে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন মিজ ফাতেমা। বলেন, “সরকারের অ্যাকশন কী? তারা এত ইনএক্টিভ কেন? তাদের ফোর্সগুলা কোথায়?”
সূত্র: বিবিসি বাংলা