সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :
বিশ্বজগতের আলোকরেখা যেমন আত্মজগতে কাজ করে, তেমনি খোদায়ি ব্যবস্থাপনার সর্বজনীন বহিঃপ্রকাশ মানবজীবনে পূর্ণ মাটি ও পানির মিশ্রণ নিয়ে জ্বলজ্বল করছে। সুন্দর অবকাঠামোর মহিমা নিয়ে সৃষ্টির উদ্দেশ্য বহিঃপ্রকাশের আগে মানুষের জীবন একটি ধারাক্রমের মধ্যে দিয়ে গেছে। এই তথ্য বিজ্ঞান বহু শতাব্দীর পর জানতে পেরেছে বা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে, অথচ পবিত্র কোরআন সেগুলো বর্ণনা করেছে ১৪০০ বছর আগেই।
রাসায়নিক বিবর্তনের পর্যায়ক্রম
কোরআন গবেষণা করে জানা যায় যে মানবজীবনের রাসায়নিক বিবর্তন কমবেশি সাতটি ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, যা নিম্নরূপ—
১. মাটি
২. পানি
৩. কাদামাটি
৪. এঁটেল মাটি
৫. পচা কাদার শুকনা ঠনঠনে মাটি
৬. পোড়া মাটির সদৃশ শুষ্ক মাটি
৭. মাটির নির্যাস
কোরআনে উপরিউক্ত সাতটি পর্যায়ক্রমকে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিম্নে তা বিশদভাবে তুলে ধরা হলো—
মাটি
আল্লাহ তাআলা অস্তিত্বহীন মাটি থেকে মানুষের প্রথম নির্যাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, ‘তিনিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।’ (সুরা : আল মুমিন, আয়াত : ৬৭)
জৈবিক বিবর্তনের কিছু পর্যায়ও এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তারপর শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর জমাট রক্ত থেকে।
তারপর তিনি তোমাদের শিশুরূপে বের করেন, তারপর (তোমাদের প্রতিপালন করেন) যাতে তোমরা উপনীত হও পূর্ণ বলবত্তায়, তারপর হও বৃদ্ধ।’ (সুরা : আল মুমিন, আয়াত : ৬৭)
পানি
প্রতিটি জীবের সৃষ্টিতে পানি একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে বিদ্যমান, কিন্তু আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টিতে পানিকে একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং তিনিই পানি দ্বারা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আল ফুরকান, আয়াত : ৫৪)
এ দ্বারা প্রতীয়মান হয়, মানব সৃষ্টির এই ধারাটি আল্লাহর ব্যবস্থাপনার বহিঃপ্রকাশ।
মানুষ ছাড়াও পৃথিবীতে বসবাসকারী লক্ষাধিক প্রাণীর প্রথম সৃষ্টিতে পানির গুরুত্ব আছে যতটা মানুষের রাসায়নিক সৃষ্টিতে বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে অন্য জায়গায় বলা হয়েছে : ‘এবং প্রাণবন্ত সব কিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এর পরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (সুরা : আল আম্বিয়া, আয়াত : ৩০)
এই আয়াত বিজ্ঞানীদের জন্য চিন্তার বিষয় এবং ঈমানের প্রতি আহ্বায়ক, যারা মানবজীবন বা পার্থিব জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে গবেষণা করছেন।
কাদামাটি
মানুষের রাসায়নিক সৃষ্টিতে মাটি ও পানি মৌলিক উপাদান। এ দুটি উপাদানের সংমিশ্রণে কাদামাটি গঠিত হয়।
কাদা মাটি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের নরম মাটি (কাদা মাটি) দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আল আনআম, আয়াত : ২)
উল্লেখ্য যে কোরআনের অনুবাদকরা সাধারণত ‘তুরাব’ ও ‘ত্বিন’ উভয় শব্দের অর্থই ‘মাটি’ বলে উল্লেখ করেছেন, যা থেকে একটি ভ্রান্তি তৈরি হতে পারে যে এই দুটি পৃথক পর্যায়, নাকি একই পর্যায়ের দুটি ভিন্ন নাম? ইমাম রাগিব ইস্পাহানি (রহ.) বলেন, ‘তুরাব’ মানে প্রকৃত জমিন তথা মাটি। (আল মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃষ্ঠা-১৬৫)
আর ‘ত্বিন’ সেই মাটিকে বোঝায়, যা পানির সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে : মাটি ও পানি একসঙ্গে মিশ্রিত হলে তাকে ‘কাদা মাটি’ বলে। (আল মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃষ্ঠা-৫৩৩)
এঁটেল মাটি
কাদা মাটির পর ‘এঁটেল মাটি’-এর পর্যায় এসেছে, যা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘আমিই তাদের সৃষ্টি করেছি এঁটেল মাটি থেকে।’ (সুরা : আছ ছাফফাত, আয়াত : ১১)
এঁটেল মাটি হলো কাদা মাটির পরবর্তী রূপ, যখন কাদা ঘন হয়ে যায় তখন এঁটেল মাটিতে রূপ নেয়। আরবি অভিধানে বলা হয়েছে, কাদা থেকে পানির প্রতিক্রিয়া হারিয়ে গেলে তাকে ‘এঁটেল মাটি’ বলে। (শুবুহাতুল মুশাককিকিন, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৮৪)
মোটকথা, যখন কাদা সামান্য শক্ত ও আঠালো হয়ে যায়, তখন এঁটেল মাটিতে রূপ নেয়। পচা কাদার শুকনা ঠনঠনে মাটি
মাটি ও পানি থেকে তৈরি কাদা শুকাতে শুরু করলে গন্ধ বের হতে থাকে, আল্লাহ তাআলা এই গন্ধযুক্ত পদার্থের নাম দিয়েছেন ‘পচা কাদার শুকনা ঠনঠনে মাটি’। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি পচা কাদার শুকনা ঠনঠনে মাটি থেকে।’ (সুরা : আল হিজর, আয়াত : ২৬)
এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে মানব সৃষ্টির রাসায়নিক বিবর্তনের এই পর্যায়টি এঁটেল মাটির পরবর্তী ধাপ। এখানে ‘সালসাল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইমাম রাগিব ইস্পাহানি (রহ.) বলেন, শুষ্ক বস্তু দ্বারা উৎপাদিত শব্দের কম্পন অর্থাৎ ঠনঠন। এই কারণেই শুকনা কাদা মাটিকে ‘সালসাল’ বলা হয়; কারণ এটি ঠনঠন শব্দ করে। (আল মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃষ্ঠা-৪৮৮)
‘সালসাল’ শুষ্ক মাটিকে বোঝায়, যা শুষ্কতার কারণে বেজে ওঠে অর্থাৎ শব্দ ধ্বনিত হয়। (লিসানুল আরব, খণ্ড-১১, পৃষ্ঠা-৩৮২)
পোড়া মাটির সদৃশ শুষ্ক মাটি
মানুষের রাসায়নিক বিবর্তনের ষষ্ঠ পর্যায় হলো পোড়া মাটির সদৃশ শুষ্ক মাটি, যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই মানুষকে পোড়া মাটির মতো শুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আর রহমান, আয়াত : ১৪)
যখন গরম করা এবং পোড়ানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তখন কাদা পুড়ে শুষ্ক হয়ে যায়। আর এই অবস্থাকে আল্লাহ তাআলা ‘কাল ফাখখর’ (পোড়া মাটির মতো) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
মাটির নির্যাস
মানুষের রাসায়নিক সৃষ্টির শেষ পর্যায় হলো মাটির নির্যাস। সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে।’ (সুরা : আল মুমিনুন, আয়াত : ১২)
এই আয়াতে কাদা থেকে পরিশোধিত ও বিশুদ্ধ নির্যাসের কথা উল্লেখ আছে, যেখান থেকে প্রকৃত সারাংশ নির্বাচন করা হয়েছে। এখানে মানবজীবনের রাসায়নিক বিবর্তনের শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার বর্ণনা রয়েছে।
ইমাম রাগিব ইস্পাহানি (রহ.) বলেন, মাটির নির্যাস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মাটি থেকে নির্বাচিত সারাংশ, যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অমেধ্য থেকে পরিশোধিত ও বিশুদ্ধ করা হয়েছে। (আল মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃষ্ঠা-৪১৮)
সুতরাং মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করার এক অর্থ তো এই যে আদি পিতা আদম (আ.)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তারপর তাঁর ঔরস থেকে প্রজন্ম পরম্পরায় মানুষ জন্মলাভ করেছে। অর্থাৎ সরাসরি মাটির সৃষ্টি কেবল আদম (আ.) আর বাকি সবাই মাটির সৃষ্টি তাঁর মাধ্যমে।
দ্বিতীয় অর্থ হলো, মানুষ সৃষ্টির সূচনা হয় শুক্রবিন্দু থেকে। শুক্রের মূল হলো খাদ্য আর খাদ্য উৎপাদনে মাটির ভূমিকাই প্রধান। সুতরাং পরোক্ষভাবে সব মানুষই মাটির সৃষ্টি। অর্থাৎ প্রথমে মাটি, অতঃপর তা থেকে উদ্ভিদের মাধ্যমে খাদ্য অর্জিত হয়। এরপর তা থেকে বীর্য সৃষ্টি হয় আর সেই বীর্য থেকেই মানুষ সৃষ্টি হয়, যা (নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত) এক সংরক্ষিত আধারে (অর্থাৎ গর্ভাশয়ে) অবস্থান করে (যা খাদ্য থেকে অর্জিত হয়েছিল), অতঃপর বীর্য জমাট রক্ত রূপ নেয়।
এরপর জমাট রক্ত (মাংসের) পিণ্ডে রূপ নেয়। এরপর পিণ্ড (অর্থাৎ পিণ্ডের কতক অংশ) অস্থিতে রূপ নেয়। এরপর অস্থি মাংস পরিণত হয়। ফলে অস্থি আবৃত হয়ে যায়। এরপর (অর্থাৎ এসব বিবর্তনের পর) আল্লাহ তাআলা (তাতে রুহ নিক্ষেপ করে) তাকে এক নতুনরূপে দাঁড় করিয়েছেন (যা পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে খুবই স্বতন্ত্র ও ভিন্ন। কারণ এর আগে একটি নিষ্প্রাণ জড় পদার্থের মধ্যে সব বিবর্তন হচ্ছিল, এখন তা একটি প্রাণবিশিষ্ট জীবিত মানুষে পরিণত হয়েছে)। অতএব, শ্রেষ্ঠতম কারিগর হলেন আল্লাহ তাআলা। কেননা, অন্যান্য কারিগর আল্লাহর সৃজিত বস্তুসমূহে জোড়াতালি দিয়েই কোনো কিছু তৈরি করতে পারে। জীবন সৃষ্টি করা বিশেষভাবে আল্লাহ তাআলারই কাজ।
আল্লাহ তাআলা আমাদের পবিত্র কোরআনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বোঝার এবং নিজেদের ঈমান শক্তিশালী করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সূত্র: কালের কণ্ঠ