মঞ্জুরুল আলম মাসুম, নাটোর:
জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেনের শহর নাটোর থেকে ১৭ কি. মি. দক্ষিণে বাগাতিপাড়া উপজেলা। পিচ ঢালা পথবেয়ে চলতে গিয়ে উপজেলা পরিষদের দেড় কিলোমিটার দূরে চোখে পড়বে বিহারকোল বাজার। বাগাতিপাড়া পৌরসভার অর্ন্তগত পদ্মার শাখা বড়াল নদের তীরে অবস্থিত বাজারটি। অদূরেই রয়েছে জমিদার গিরিশ রায়ের ঐতিহাসিক বাড়ি। বাজারের সাথেই গালিমপুর ব্রীজ।
সেই ব্রীজে উঠতেই দেখা মেলে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। দোকানে চা বানাচ্ছেন মধ্য বয়সি এক নারী। নাম তাঁর রেহানা। সবাই ডাকে রেহানা বুবু নামে। বয়স ৫৫। চোখের নিচে কাল দাগ, কুচকে গেছে শরীরের চামড়া। কপালে বলি রেখা। দেখলেই মনে হয় জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এক নারী।
চা পান করতে গিয়ে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানালেন তার জীবন সংগ্রামের কাহিনী। সহায় সম্বলহীন রেহানাকে শিশুকাল থেকেই নামতে হয় জীবনযুদ্ধে। অভাব অনটনের সংসার বাবার। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও পড়ালেখা হয়নি শিশু রেহানার। মামা কালু প্রামানিকের সংসারে সহযোগিতা করার সুবাদে আশ্রয় মেলে মামার বাড়িতে। স্বামী সংসার সর্ম্পকে কিছু বোঝার আগে পার্শ্ববর্তি আরেক সহায় সম্বলহীন সব্জী ব্যবসায়ী কাদেরের সাথে বিয়ে হয় তার। রেহেনার কোল জুড়ে আসে পরপর দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে।
সংসারের প্রতি উদাসীন স্বামী কাদের ও সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা রেহানা কাজের সন্ধানে ছুটে যান এখানে ওখানে। হঠাৎ পরিচয় হয় এনজিও ব্র্যাক কর্মকর্তা এক আপার সাথে, মিলে যায় রেহানার কাজের সুযোগ। পনেরশ’ টাকা বেতনে ব্র্যাকে শুরু হয় রেহানার নতুন জীবন। ব্র্যাক অফিসেই চা বানানোর হাতিখড়ি হয় তার। স্বচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে তাঁর সংসারে। চাকরিরত অবস্থায় তাঁর তিন সন্তানকে বিয়েও দেন রেহানা। ছয় বছর চাকরী করার পরে পারিবারিক কারণে চাকরী ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। আবার রেহানার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। শুরু হয় রেহানার জীবনের তৃতীয় ইনিংস।
জমানো কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন বিহাড়কোল বাজারে চায়ের দোকান। তিনি একাই দোকান চালান মাঝে মধ্যে তাঁকে সহযোগীতা করেন তাঁর স্বামী ও ছেলে। সহজ সরল রেহানার আচরনে মুগ্ধ খদ্দের সুযোগ পেলেই এক কাপ চা পান করতে বাজারে আসেন অনেকে। চায়ের দোকান সকাল ছয়টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত, আবার বিকেল চারটা থেকে রাত্রি ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিদিন প্রায় ২শ’ ৫০ থেকে ৩শ কাপ চা বিক্রি করেন রেহানা। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে চলছে রেহানার সংসার।
চাকরি ছাড়ার পর এভাবে চলছে প্রায় ১০ বছর। চা বিক্রি করে তিনি এক টুকরো বাড়ি করার মত জায়গাও কিনেছেন। সেখানে তিন রুমের একটি আধা পাকা বাড়িও তৈরি করেন রেহানা। এভাবেই নারী হয়েও জীবনযুদ্ধে অদম্য রেহানা এগিয়ে চলেছে এক সুন্দর স্বপ্নের বাস্তবায়নে।
স/আ