সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :
আচরণবিধি প্রতিপালনে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা, ইসিতে তলবসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে নির্বাচন কমিশনের করা মামলায় প্রার্থীরা স্বস্তিতে থাকবেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের দাবি, নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে সেটা নিষ্পত্তি হতে হতে প্রার্থীরা এমপি হয়ে যাবে। এজন্য বিধিবিধানের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে প্রার্থীদের আচরণবিধি প্রতিপালনে বাধ্য করতে হবে।
# প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় চলে যায়
# আচরণবিধি লঙ্ঘনের নামে ফৌজদারি অপরাধ হচ্ছে
# ফৌজদারি অপরাধ করলে বিধিবিধানের সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করতে হবে
# প্রার্থিতা বাতিলে আদালতকে সহযোগিতা করতে হবে
আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত : ২৪ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি আব্দুল হাই এবং চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। ঝিনাইদহ-১ আসনের প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে দুটি ঘটনায় পৃথক পৃথক মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে ইসি।
শম্ভুকে ইসিতে তলব, তদন্ত রিপোর্টের আলোকে এমপি বাহারের বিরুদ্ধেও শিগগিরই ব্যবস্থা : বরগুনা-২ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে ব্যক্তিগতভাবে কৈফিয়ত তলবের জন্য ইসিতে ডাকা হয়েছে। এছাড়া, কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান এমপি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের ওপর হামলার অভিযোগে দুই তদন্ত প্রতিবেদন ইসিতে এসেছে। আওয়ামী লীগের এই এমপির বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ইসি।
এর আগে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কুমিল্লা-৬ আসনের নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারকে ৫ দিনে ৩টি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। গত ২০ ডিসেম্বর কুমিল্লা নগরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামের ফটকে বাহাউদ্দিনের নির্দেশে তার নেতাকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক কাজী এনামুল হক এবং সাইদুর রহমানের ওপর হামলা করে মোবাইল ফোন ও লাইভ ডিভাইস ছিনিয়ে নিয়ে যান। সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান যুগ্ম জেলা জজ মো. সিরাজ উদ্দিন ইকবাল নৌকার প্রার্থী বাহাউদ্দিনকে তৃতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ : ২৪ ডিসেম্বর সকালে কুষ্টিয়া শহরের কলকাকলি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে নতুন কারিকুলাম বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসা ১ হাজার ২৮০ জন শিক্ষককে ডেকে এনে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে শিক্ষক সমিতির নেতারা। সেই সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন কুষ্টিয়া-৩ আসনের এমপি নৌকার প্রার্থী মাহবুব উল আলম হানিফসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। সভায় নৌকা প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী। এ ঘটনায় নির্বাচন কমিশন ও অনুসন্ধান কমিটিতে লিখিত অভিযোগ দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী পারভেজ আনোয়ার তনু। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গঠিত নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি সংসদীয় কুষ্টিয়া-৩ অঞ্চলে নৌকার প্রার্থী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত দলীয় প্রার্থী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও তার ভাই কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতাকে শোকজ নোটিশ পাঠান। আগামী ২৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় অনুসন্ধান কমিটির প্রধান যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতের বিচারক মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের কার্যালয়ে হাজির হয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ : ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী দলটির জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে শোকজের চিঠি পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া নির্ধারিত সময়ে জবাব না দিয়ে সময় নেন।
মমতাজ বেগম : নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগমকে শোকজ নোটিশ দিয়েছিল নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। মানিকগঞ্জের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ রেজমিন সুলতানা তাকে শোকজ করেন।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া : চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দুইবার শোকজ করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চাঁদপুর-২ এর চেয়ারম্যান এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ (২য় আদালত) সাইয়েদ মাহবুবুল ইসলাম শোকজ করেন তিনি।
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম : আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ঢাকা-৮ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকেও কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছিল নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। গত ৯ ডিসেম্বর নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি ও যুগ্ম জেলা জজ মোছাম্মৎ ইছরাত জাহান নাসরিনের তাকে শোকজ করেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান : নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানকে শোকজ করেছিল নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। গত ১৩ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ-৩ আসনের নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ও যুগ্ম জেলা জজ রশিদ আহমেদ মিলন মন্ত্রীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাখ্যা চান।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম : আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও নৌকার প্রার্থী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। তার নির্বাচনী এলাকার এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এ নোটিশ দেওয়া হয়। শাহরিয়ার আলমের কাছে সশরীরে হাজির হয়ে জবাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান : মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকেও শোকজ করেছিল অনুসন্ধান কমিটি। ঢাকা থেকে মাগুরায় যাওয়ার সময় কামারখালী এলাকা থেকে গাড়িবহর নিয়ে মাগুরা শহরে ঢোকেন। তিনি নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এতে চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ফলে তাকেও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় অনুসন্ধান কমিটি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে এটা ফৌজদারি অপরাধ হয়ে যাচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু যদি ফৌজদারি অপরাধ হয়, তাহলে সেটা তো আচরণবিধির মধ্যে পড়ে না।
আচরণবিধি ভাঙায় দুইজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করলে সেটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে যায়। এইসব মামলার সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে চলে আসবেন। প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তারা স্বস্তিতেই থাকবেন। যেমন কুমিল্লার বাহার সাহেবকে এর আগে, সিটি ভোটে এলাকা ছাড়তে বলেছিল ইসি। কিন্তু উনি কিন্তু এলাকা ছাড়েননি। আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছিল। এজন্য যেসব প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিধিবিধানের সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করতে হবে ইসিকে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে কেউ ফৌজদারি অপরাধ করলে ইসি তাদের প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেই প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে। এর আগেও উনারা একটা প্রার্থিতা বাতিল করেছেন এবং আমাদের সময়েও আমরা অনেক নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিল করেছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা বাতিল করলে হাইকোর্ট আবার প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেয়। প্রার্থিতা বাতিল বিষয়ে হাইকোর্ট আমাদের একবার এ ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করেছিল। এখন প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে আদালতকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।