সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক
মাস কয়েক আগে গরুর মাংসের দাম বাড়তে বাড়তে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু গরুর দাম এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় হঠাৎ করে বাজারে চাহিদা পড়ে যায় এ মাংসের। এ জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে দাম কমানোর পথে হাটেন বিক্রেতারা। অবশ্য দাম কমলেও বাজার স্থির হয়নি; একেক দোকানে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। কোথাও ৭০০ টাকা, কোথাও ৬৫০, কোথাও ৬৩০, কোথাও ৬০০, আবার কোথাও বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকায়।
রাজধানীর কদমতলী, জুরাইন, শাহজাহানপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গরুর মাংসের দামের ভিন্নতা পাওয়া যায়। বিক্রেতারা বলছেন, দাম ৭৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেলে বিক্রি অনেক কমে যায়। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের পর মাংস ব্যবসায় ক্রেতাখরা দেখা দেয়। বিক্রি না থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। তাই কম লাভে হলেও দাম কমিয়ে বিক্রি করছেন অনেক বিক্রেতা। এতে চাহিদা ও বিক্রি দুটোই বেড়েছে।
কম লাভে দাম কমিয়ে গরুর মাংস বিক্রি করায় আলোচনায় এসেছেন রাজধানীর শাহজাহানপুরের মাংস ব্যবসায়ী খলিল আহমেদ ও মিরপুরের উজ্জল। গত রবিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক সেমিনারে তাদের সাধুবাদও জানানো হয়। কিন্তু সেমিনারে উপস্থিত বাকি মাংস ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়তে হয় তাদের।
খলিল আহমেদ জানান, মাংসের দাম বাড়ার সঙ্গে ব্যবসা কমে গিয়েছিল। ফলে গরু জবাইও কমাতে হয়েছে। কিন্তু দাম কমানোয় বিক্রি অনেক বেড়েছে। আগে তিনি দিনে ৩ থেকে ৪টি গরু জবাই করতেন। এখন জবাই করেন ৩০ থেকে ৩২টি।
লালবাগের নবাবগঞ্জ বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৫৮০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে। এতে দোকানগুলোর সামনে ভোক্তাদের ভিড়ও বেড়েছে। বিশেষ করে শুক্রবারে ভিড় বেশি থাকছে। অনেক দোকানে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও সেখানে হাড়-চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নিউমার্কেট ও কাঁটাবন বাজারে দাম খুব একটা কমেনি; কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। একই চিত্র দেখা গেছে ধানমন্ডি ও ঝিগাতলা এলাকাগুলোর বাজারগুলোতে।
এলাকাভেদে দামে এত ব্যবধান থাকায় ভোক্তাদের মনে প্রশ্ন উঠেছে- গরুর মাংসের যৌক্তিক দাম তা হলে কত? বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এক দোকান থেকে আরেক দোকানে দামের পার্থক্য কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। এক বিক্রেতা কমে পারলে অন্যরা পারছে না কেন? তার মানে বাজারে কারসাজি রয়েছে। আমরা ভোক্তারা প্রতিনিয়ত ঠকছি।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাংস উৎপাদন হয় ৮৭ লাখ টন। এ সময় দেশের বাজারে মাংসের চাহিদা ছিল ৭৬ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় দেশে অতিরিক্ত মাংস উৎপাদন সত্ত্বে¡ও বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
গরুর মাংসের কেজি ৫০০ টাকা হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি বলেন, এ খাতে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। সিটি করপোরেশন দাম নির্ধারণ বন্ধ করার পর একলাফে দাম বেড়ে ৫০০ টাকা হয়। এরপর তা দফায় দফায় বেড়ে ৮০০ টাকায় উঠেছে। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা রয়েছে। তা ছাড়া উত্তর সিটি করপোরেশনের অনীহা ও ‘গোপন সম্পর্ক’ থাকায় অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের বিষয়ে হাটের ইজারাদাররা আজ পর্যন্ত জবাবদিহিতার বাইরে রয়েছেন। চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়নি।
মাংসের বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালচনায় গত রবিবার ভোক্তা অধিদপ্তরে খুচরা ও পাইকারি মাংস ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ), সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সেমিনার হয়। এতে দাম কমাতে করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান। একপর্যায়ে সেমিনারে হট্টগোল বেধে সেমিনারটি কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়।
ভোক্তার ডিজি বলেন, আমাদের দুটি বড় সংগঠন ‘মাংস ব্যবসায়ী সমিতি’ ও ‘বিডিএফএ’ আগামী বুধবার নিজেরা বসবেন। তারা দাম কমাতে করণীয় এবং কত দাম নির্ধারণ করা যায়, তা ঠিক করবেন। এরপর বৃহস্পতিবার সেটি লিখিতভাবে জানাবেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু পারা যায় আমরা ব্যবস্থা নেব। না পারলে সরকারের সংশ্লিষ্ট জায়গায় পাঠাব। গরুর উৎপাদন খরচ ও মাংসে দাম কত হওয়া উচিত, সেটি অনুসন্ধান করার জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান ডিজি।
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, দাম যেহেতু কমছে, তার মানে অন্যরাও কমাতে বাধ্য হবেন। অন্যদেরও কমানো উচিত। কারণ যারা কমিয়েছেন, তাদের লাভ কমলেও ব্যবসা বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, মূল্য নির্ধারণে জোর না দিয়ে দাম কমার প্রবণতা যেন অব্যাহত থাকে, আবার যেন না বাড়ে, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ‘মার্কেট ইকোনমিতে’ দাম বেঁধে কাজ হবে না। উৎপাদন বাড়ানো ও সরবরাহের উন্নতির পাশাপাশি গো-খাদ্যের দাম কীভাবে কমানো যায়, খামারের খরচ কমানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) গরুর মাংসের দাম কেজিতে ৫০ টাকা কমানোর ঘোষণা দিলেও কার্যকর হয়নি। যদিও বিডিএফএর দাম কমানোর ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি বলেন, তারা মাংস বিক্রি করেন না, সুতরাং তারা দাম বেঁধে দিতে পারেন না।