পথভ্রষ্ট সদস্যদের সেদিনের ওই হামলায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ নিহত হন ৭৪ জন। রাইফেলস সপ্তাহের বর্নিল আয়োজনের মধ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিয়ার জওয়ানদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়।
কিন্তু পিলখানার চার দেয়ালের ভেতরের এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বুঝতে সময় লেগে যায় আরও দুইদিন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের অবসান ঘটলে পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ।
২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। উদ্ধার করা হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র।
নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের পর ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকা মহানগর তৃতীয় বিশেষ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়।
সেদিন যা ঘটেছিলো
আদালতে প্রত্যক্ষদর্শী অফিসার ও সৈনিকদের জবানবন্দিতে সেদিনের ভয়াবহ চিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, জওয়ানদের একটি দল সকাল ৯টার কিছু আগে অস্ত্রাগারে গিয়ে সেখানে দায়িত্বরত এক মেজরকে জিম্মি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। সেখানে দায়িত্বরত কোনো বিডিআর সদস্য তাতে বাধা দেননি।
২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় পিলখানায় দরবার হলে বার্ষিক দরবার শুরু হয়। সারা দেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ ২ হাজার ৫৬০ জন সদস্যে তখন পরিপূর্ণ দরবার হল।
৯টার কিছু পর দরবার হলে প্রবেশ করে মঞ্চে বসেন ডিজি শাকিল আহমেদ। সাড়ে ৯টার দিকে শাকিলের বক্তব্য চলাকালীন সিপাহী মাঈন মঞ্চে উঠে ডিজির দিকে অস্ত্র তাক করেন। এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে নিরস্ত্র করেন।
সঙ্গে সঙ্গে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের একটি অংশ দরবার হলে ঢুকে মহাপরিচালকের সামনে তাদের নানা দাবি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। মহাপরিচালক শাকিল সবাইকে বারবার শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট সামাল দিতে বলেন।
এরপরই সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল সশস্ত্র অবস্থায় দরবার হলে ঢুকে পড়লে সব পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ভেতরে শুরু হয় গোলাগুলি। প্রায় তিন হাজার সৈনিক এবং জেসিও মুহূর্তের মধ্যে যে যেভাবে পেরেছে জানালা বা দরজা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেছেন।
ডিজি, ডিডিজি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৪৫-৫০ জন দরবার হলে অবস্থান করে আলোচনা করতে থাকেন। অন্যদিকে সিপাহীরা বাইরে গিয়ে নিজেদের সংগঠিত করে। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে দেখা যায় লাল সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিডিআরের একদল সৈনিক দরবার হল ঘিরে কিছুক্ষণ পর গুলি করে।
ডিজি তখনও সমাধানের পথ খুঁজছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল ফোনে সাহায্যের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাতে অনুরোধ করছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় বিদ্রোহী সৈনিকরা চিৎকার করে কর্মকর্তাদের মঞ্চের ভেতর থেকে বের হতে বলে। তখন মঞ্চের নিচে ১৫-১৬ জন বিদ্রোহী কাপড়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল।
দরবার হলের মঞ্চের পর্দার আড়ালে উত্তর দিকে ডিজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। বিদ্রোহীরা হ্যান্ডমাইকে বলছিল, ‘ভেতরে কেউ থাকলে বের হয়ে আসেন। ’ মুখে কাপড় বাঁধা একজন সৈনিক অস্ত্রহাতে পর্দা সরিয়ে মঞ্চে ঢুকে চিৎকার করে বলে, ‘ভেতরে কেউ আছেন? সবাই বের হন। ’ একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে দুটি গুলি করে সে।
এরপর ডিজিসহ একে একে অন্য কর্মকর্তারা পর্দা সরিয়ে বাইরে আসেন। মঞ্চের নিচে নেমেই কর্মকর্তারা ডিজি শাকিলকে মধ্যে রেখে গোল হয়ে দাঁড়ান। একজন সৈনিক চিৎকার করে অশালীন ভাষায় তাদের সিঙ্গেল লাইনে দাঁড়াতে বলেন। এরপরই একে একে হত্যা করা হয় তাদের।
শুরু হয় পিলখানাজুড়ে তাণ্ডব। চলে সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারকে হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। খবর পেয়ে সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে সাঁজোয়া যান এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে পিলখানার দিকে রওনা হন সেনা সদস্যরা।
বেলা ১১টার মধ্যেই তারা ধানমন্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন তারা। বিডিআরের ১ ও ৫ নম্বর গেটের আশপাশসহ বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়। বিদ্রোহীরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনা সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। তারা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে।
দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম।
ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানানো হয়।
কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানরা। এরমধ্যে সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ
২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে পিলখানায় বিডিআরের সংখ্যা কমতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পোশাক বদলে ফেলে পিলখানার বিভিন্ন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন বিডিআর জওয়ানরা। একপর্যায়ে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা আবার অস্ত্র সমর্পণের কথা বলেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তারা অস্ত্র এবং অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চাবি বুঝিয়ে দেন। পরে পুলিশ পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিলে অবসান ঘটে ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের। ২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দরবার অনুষ্ঠানের আয়োজনকে সামনে রেখেই ষড়যন্ত্রকারীরা নিয়েছিল বিদ্রোহের প্রস্তুতি। জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, রেশন-বৈষম্য, ডাল-ভাত কর্মসূচির নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগসহ নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল।
২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সপ্তাহ শুরুর দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় আসেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের দাবিদাওয়ার কিছু না হওয়ায় সুবেদার গোফরান মল্লিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন কিছু জওয়ান।
জানা যায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সঙ্গে তার বাসার কাছে কয়েকজন বিডিআর সদস্য কথা বলেন। পরে পিন্টু তাদের ৫ নম্বর ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যান।