ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইটি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। মঙ্গলবার সকালে ঢাকার মানিকনগর থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে বাসযাত্রায় পাশের সিটের যাত্রী তিনি।
খানিক আলাপচারিতায় জানা গেল, তার বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার চরমটুয়া। কথাবার্তায় মনে হলো তিনি রাজনীতি সচেতন। তাই তার কাছে প্রশ্ন ছিল -আপনি একরাম সাহেবের সংসদীয় এলাকার বাসিন্দা। একরাম ও মির্জা সাহেবের মধ্যে হচ্ছেটা কি? জানেন কিছু?
কথা না বাড়িয়ে সাফ জবাব মিজানুরের -‘সবই স্বার্থের দ্বন্দ্ব। একরাম এমপি সবদিক দিয়েই ফুলেফেঁপে একাকার। আর মির্জা কাদের যার-তার বিরুদ্ধে সত্য কথা প্রকাশ করায় অনেকেই তা পছন্দ করছেন না। আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে এখন তিনি অনেকটা কোণঠাসা। কোণঠাসা অবস্থায় কেউ ঘুরে দাঁড়াতে চাইলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।’
বাস থেকে মাইজদী শহরে অবস্থিত জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অদূরে নেমে বয়সে যুবক মিজানুরের কথার সূত্র ধরেই তথ্য-তালাশ শুরু। তার কথা যে একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল মির্জা কাদেরের একটি ফোন কলে। মঙ্গলবার স্থানীয় পুলিশ স–পারকে করা ওই ফোনের অপর প্রান্তে উত্তেজিত মির্জা কাদের ধমকের সুরে বলছিলেন, ‘আমার লোক ছেড়ে দিন। না হলে আমি প্রধানমন্ত্রীকে সব জানাব। সমাবেশ করব। আমি এটা চালিয়ে যাব।’ পুলিশ সুপার তাকে বলছিলেন, ‘আপনি সমাবেশ করবেন না বলে কথা দিয়েছেন। মামলার তদন্ত অনুসারে আমরা ব্যবস্থা নিব। জামিন করিয়ে নিবেন কোর্ট থেকে। আপনি প্রোগ্রামটা এখানে আর করবেন না। স্যারের মেসেজটা আপনাকে দিচ্ছি।’
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর এ উত্থানটাকেই মেনে নিতে পারছেন না ছাত্রলীগের রাজনীতি করে উঠে আসা আবদুল কাদের মির্জা।
এ নিয়ে তার বড়ভাই ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে গিয়েও ইতিবাচক সাড়া পাননি। এরপর থেকেই তিনি চরম ক্ষেপে গিয়ে সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন হাজারী ও তাদের অনুসারীদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজিতে জড়ানোর অভিযোগ এনে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তার এসব বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। একপর্যায়ে তিনি নিজের ভাই ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্পর্কেও সমালোচনা করেন। তার সেসব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এসবের ধারাবাকিতায় দ্বন্দ্ব রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘাতে।
শুক্রবার দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে মারা যান স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি ও সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে করা সাংবাদিক খুনের মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তর করা হয়েছে। আর পুলিশের ওপর হামলা ও কাজে বাধা দেয়ার মামলায় মির্জা কাদেরের এক কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওই কর্মীকে ছাড়াতে ব্যর্থ চেষ্টা চালান তিনি।
ওই ঘটনার পর সোমবার বিকালে দুই পক্ষ ফের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। বিষয়টি কঠোর হাতে সামাল দিতে স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেন পুলিশের হাইকমান্ড। এ নির্দেশের কথাও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই মির্জা কাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়।
এরপরও বসুরহাটের রূপালী চত্বরে পাল্টাপাল্টি সমাবেশের আয়োজন করে কাদের মির্জা ও একরামুল করিমের অনুসারীরা। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ মির্জা কাদেরকে সেখানে সমাবেশ করতে দেয়নি। নির্ধারিত স্থানে সমাবেশ করতে না পেরে তিনি পৌরসভা কার্যালয়সংলগ্ন বটতলায় নেতাকর্মীদের নিয়ে দীর্ঘ সময় বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি আগের মতোই সংসদ সদস্য একরামুল করিম ও নিজাম হাজারীর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হজারীকে বুধবার দুপুরে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরে এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন বলেন, এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যা করা দরকার পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে তাই করা হচ্ছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে চাইলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সোমবার রাতেই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে সেখানে দলের কোনো নেতার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করলে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে -এ মর্মে দলটির কেন্দ্র থেকে হুঁশিয়ার করা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, আমরা কেউই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নই। দলের হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত দেয় আমরা সেটা পালন করি।
টেন্ডারবাজি, চাকরি-বাণিজ্যসহ অপরাজনীতিতে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা কাদেরকে উদ্দেশ করে একরামুল করিম বলেন, ‘উনি সুস্থ হলে এসব করতে পারতেন না। উনি যেভাবে কথা বলেন, হাত নাড়েন সুস্থ হলে তা করতে পারতেন না। এখন পার্টির সেক্রেটারির ভাই এমন অসুস্থ হলে তাকে সুস্থ করার দায়িত্বও সেক্রেটারি সাহেবের।’
খেঁাঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় এ সিদ্ধান্তের পর মঙ্গলবার মির্জা কাদের দলীয় কোনো কার্যক্রম চালাননি। সকালে তিনি বসুরহাট পৌরসভার যানজট নিরসন ও ফুটপাতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কাজে নেতৃত্ব দেন। একই সঙ্গে তিনি ড্রেনেজ ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন।
কোম্পানীগঞ্জে দলীয় কার্যক্রম স্থগিতসহ সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বুধবার মির্জা কাদের বলেন, নেত্রীর নির্দেশ শিরোধার্য। নেত্রী আমাকে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে যেতেও নিষেধ করেছেন। তাই এখন আমি আর কোনো কথা বলব না।
২০১৬ সালের ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বাদল বিজয়ী হন। তখন মির্জা কাদের তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কারণ নির্বাচনে সাবেক চেয়ারম্যান ঢাকার ব্যবসায়ী সাহাব উদ্দিন নির্বাচন করতে চাননি। চেয়ারম্যান হওয়ার পরই নানা অনৈতিক কাজে জড়ানোর কারণে মির্জা কাদেরের সঙ্গে বাদলের দূরুত্ব তৈরি হয়। স্থানীয় সাংবাদিকদের ভাষ্যমতে, তখন বাদলের বাসায় নিয়মিত মদ-জুয়ার আসর বসত।
স্থানীয় রাজনীতিতে জনপ্রিয় মির্জা কাদের ক্রমেই একা হচ্ছেন : প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় রাজনীতিতে একরামুল হক ও তার পরিবারের উত্থানে ক্রমেই একা হচ্ছেন মির্জা কাদের। এক সময়ের ঘনিষ্ঠজনদের এখন মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলছেন সংসদ সদস্য একরামুল করিম। তার বড় প্রমাণ মিজানুর রহমান বাদল। বাদলই মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ করার জন্য জনবল সরবরাহ দিচ্ছেন। বাদল এক সময় চরকাঁকড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এসব তথ্য পেয়ে আবদুল কাদের মির্জা একদিন নিজেই বাদলের বাসায় হানা দিয়ে অনৈতিক কাজে জড়িতদের মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেন। ২০০০ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সাবেক চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন ফিরে এলে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয় এবং তিনি বিজয়ী হন। অভিযোগ আছে, এরপর থেকেই বাদলকে মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছেন সংসদ সদস্য একরামুল করিম। এমনকি তার ভাগ্নে ব্যাংকার রাহাতও স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মামার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।
অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বাদল কাদের ভাইয়ের সবচেয়ে কাছের লোক। তার নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা। বাদলের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
সংসদ সদস্য একরামুলের হয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগ সম্পর্কে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল মির্জা কাদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, আমাকে উনি মাদক সম্রাট, ভূমিদস্যু আখ্যা দিয়েছেন আমি কিছু বলিনি। কিন্তু উনি যখন আমার নেতানেত্রীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, তখনই তার প্রতিবাদে আমি পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছি। তিনি সংসদ সদস্যের লোক নন বলেও দাবি করেন।
প্রশাসনের কর্তাদের ভাবনা : নোয়াখালী পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ সদস্য একরামুল করিমের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও ভাই দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আনুকূল্য না পাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে মির্জা কাদেরের কাছের লোকজনও দূরে সরে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে সংসদ সদস্য একরামুল করিমের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিকেও মানতে পারছেন না মির্জা কাদের।
আবার মির্জা কাদেরের এমন আচরণকে অনেকেই বাড়াবাড়ির দৃষ্টিতেও দেখছেন। তিনি বলেন, সার্বিক পরিস্থিতির দিকে দলের হাইকমান্ড থেকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। তবে চলমান সংকটে দলের সাধারণ সম্পাদকের নীরব থাকাকে ঘরে-বাইরের সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি যদি আগে থেকে নির্দেশনা দিতেন তাহলে আজ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। মির্জা কাদেরের আরেক সমস্যা হচ্ছে, তিনি নিজের লোকদেরও এখন আর বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না। এ কারণে তার কাছের লোকজনও দূরে সরে যাওয়ায় তিনি অস্বাভাবিক সব আচরণ করছেন।
সুত্রঃ যুগান্তর