সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
আজ ড. জোহা দিবস। দিনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষক সমাজের কাছে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৬৯ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও প্রক্টর সর্বজনশ্রদ্ধেয় ড. শামসুজ্জোহা পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন।
নিজের জীবনের বিনিময়ে সেদিন তিনি তার ছাত্রদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দেশে যেসব বেদনাময় ও আত্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল, তার মধ্যে ড. শামসুজ্জোহার শাহাদতবরণ অন্যতম।
ড. জোহার এই আত্মদানের মধ্য দিয়েই তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের ভিত নড়ে গিয়েছিল, এগিয়েছিল বাঙালি জাতির জাগরণী চেতনা, যা বেগবান করেছিল দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিকে।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টমেন্টে বন্দি অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করার প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। একই সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় জেলা প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করে।
ওইদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মুক্তিকামী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা বের করেন। শোভাযাত্রাটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ মুক্তিকামী জনতার সংঘর্ষ বাধে।
সংঘর্ষে অনেকে আহত হন, অনেকেই হন কারাবন্দি। ওই ঘটনা শোনামাত্র ড. শামসুজ্জোহা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং আহত মুক্তিকামী জনতাকে নিয়ে হাসপাতালে যান। এ ঘটনার পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে চরম উত্তেজনা।
বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নেন। অপরদিকে সশস্ত্র বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে প্রস্তুত রাখাসহ মেইন গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়, যেন ছাত্র-জনতা বের হতে না পারেন।
এরপর আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সব প্রতিরোধ ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মেইন গেটের সীমানা প্রাচীর টপকে বের হওয়া শুরু করলে শিক্ষকরা মেইন গেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীকে গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন।
এহেন সংকটময় মুহূর্তে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার দোসররা রাইফেল উঁচিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকলে ছাত্ররা পাকবাহিনীর পার্ক করা একটি গাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ড. জোহা পাকসেনা অফিসার ক্যাপ্টেন হাদির সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান এবং তাকে অনুরোধ করেন যেন সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো উসকানিমূলক পদক্ষেপ না নেয়া হয়।
আস্তে আস্তে মেইন গেট সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ছাত্র-জনতার ঢল নামতে শুরু করলে সেনাবাহিনীর লোকজন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করতে প্রস্তুত হয়। এমতাবস্থায় ড. জোহা হাত উঁচু করে পাকসেনাদের উদ্দেশে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার; আমার ছাত্ররা এখান থেকে এখনই চলে যাবে…।’
কিন্তু পাক হায়েনারা সেদিন ড. জোহার সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। কিছুক্ষণ পরই অতি নিকট থেকে তাদের রাইফেলের ছোড়া গুলি জোহার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠের দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
পরে তাকে ভ্যানে করে দ্রুত শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন পথে পথে ব্যারিকেড থাকায় তাকে হাসপাতালে নিতে বেলা গড়িয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর অপারেশন টেবিলেই মৃত্যু ঘটে তার।
ড. জোহার মৃত্যুর ঘটনা সে সময় দেশের চলমান আন্দোলনকে এনে দেয় দুর্বার গতি। তৎকালীন সরকার উপায়ান্তর না দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
দুঃখের বিষয়, শহীদ ড. জোহার আত্মত্যাগের অর্ধশত বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখন পর্যন্ত এ দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। জাতি হিসেবে আমাদের সবারই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দিবসটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com