সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের অধিগ্রহণ করা জমিতে সাঁওতালদের বসতি স্থাপনে যিনি ভূমিকা রেখেছিলেন, উচ্ছেদেও সেই শাকিল আকন্দ বুলবুলের তৎপরতা দেখা গেছে। এ বছরের শুরুতে গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত তিনি।
দুই বছর আগে যে ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি’র ব্যানারে আন্দোলনে নেমে সাঁওতালরা মাদারপুর গ্রামের ওই জমিতে বসতি গেঁড়েছিল, ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন শাকিল। গত বছর সাঁওতালদের ভোটে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার পরও জিতে শাকিল এখন ভোল পাল্টেছেন বলে এই নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের অভিযোগ।
গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে তিন সাঁওতাল নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তখন সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সাঁওতালদের শতশত একচালা ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ট্রাক্টর দিয়ে মাটি সমান করে দিয়েছে। মাদারপুর গ্রামের সাঁওতাল মামনি কিসকু, মিকাই মুরমু, সমি মরমু এবং বাঙালি আজিরন বেগম ও রুমানা বেগমসহ বেশ কয়েকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে শাকিল ও এমপি আবুল কালামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
তারা বলেন, পাকিস্তান আমলে চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা তাদের বাপ-দাদার এসব জমি পুনরুদ্ধারের আশা দেখিয়ে শাকিল দুবছর আগে তাদের সংগঠিত করেছিলেন। তার কথায় তারা ধার-দেনা করে ওই জমিতে চালাঘর তুলেছিলেন। ভোটের পর এখন উচ্ছেদ অভিযানে শাকিলই নেতৃত্ব দেন।
সাপমারার ইউপি চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল; তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ সাঁওতালদের
চেয়ারম্যান হিসেবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করলেও হামলা ও অগ্নিসংযোগে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করেছেন শাকিল। দুই বছর আগে ‘ভুল’ তথ্য পেয়ে সাঁওতালদের আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন দাবি করে শাকিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ভুল’ বোঝার পর গত জানুয়ারিতে ‘সংহতি কমিটি’র সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
ইউপি নির্বাচনের পরপরই নিজের ‘ভুল’ বুঝতে পেয়েছিলেন শাকিল, যে ভোটে নৌকার বিপরীতে তাকে আনারস প্রতীকে দল বেঁধে সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সাঁওতালরা। ঘর হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন সাঁওতাল পরিবারগুলো; যাদের অনেকে বিভিন্ন স্থান থেকে এসে শাকিলের নেতৃত্বে সেখানে বসতি গড়েছিলেন।
বুধবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ঢাকা থেকে আসা নাগরিক কমিটির একটি প্রতিনিধি দল, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়াও ছিলেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। “ওই অধিগ্রহণ চুক্তির ৫ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে, যে কারণে ওইসব জমি অধিগ্রহণ করা হলেও কখনও যদি ওই কাজে জমি ব্যবহার করা না হয়, তাহলে অধিগ্রহণকৃত জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে। পরবর্তীতে সরকার এসব জমি আগের মালিকের কাছে ফেরত দেবে।”
ব্যারিস্টার বড়ুয়া বলেন, “আমরা এর আগে এসে দেখে গেছি, এসব জমিতে মিলের জন্য ইক্ষু চাষ না করে ধান ও তামাক চাষ চলছে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকও এ ধরনের একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করেছে। মিল তার চুক্তি ভঙ্গ করেছে।”
সাঁওতালরা বলছেন, বাপ-দাদার এসব জমিতে মিলের জন্য ইক্ষু চাষ না করে কয়েক বছর আগে ধান ও তামাক চাষ করার পর তারা জমিগুলো ফেরত দেওয়ার দাবি করেন।
সংহতি কমিটির শাকিল বলেন, বাপ-দাদার দাবি করে এসব জমি ফেরত চেয়ে সাঁওতালরা আন্দোলন শুরু করার পর তাতে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। দুই বছর ধরে উপজেলা ও জেলা শহরে দফায় দফায় মিছিল-সমাবেশ ও মানববন্ধন হচ্ছিল।
“আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ১ জুলাই ওই ইক্ষু খামারের প্রায় ১০০ একর জমি দখল করার উদ্দেশ্যে নৃগোষ্ঠীর কিছু লোক একচালা ঘর নির্মাণ করে। তখন থেকে তারা তীর-ধনুক নিয়ে জমি পাহারা দেওয়া শুরু করে।”
ইউপি চেয়ারম্যান শাকিল বলেন, গত ডিসেম্বরে চিনিকল চত্বরে সাঁওতাল ও মিল কর্তৃপক্ষের এক আলোচনা সভায় ‘চুক্তির শর্তানুযায়ী, চিনিকল তার চুক্তি ভঙ্গ করলে অধিগ্রহণ করা জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে’- এটা পরিষ্কার হওয়ার পর জানুয়ারিতে ‘ইক্ষু খামার ভুমি উদ্ধার সংহতি কমিটি’র সভাপতির দায়িত্ব ছাড়েন।
তিনি বলেন, ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী অধিগ্রহণ চুক্তিপত্রের ৫ নম্বর শর্তের ‘ভুল ব্যাখা’ দিয়ে দুই বছর আগে এই আন্দোলন সংঘটিত করেন। না জেনে তিনিও জড়িয়ে পড়েছিলেন। “এছাড়া সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কও জড়িত ছিলেন।”
এ বিষয়ে কথা বলতে ফিলিমন বাস্ক ও শাহজাহান আলী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
ইন্ধনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওইদিন তিনি গোবিন্দগঞ্জেই ছিলেন না। ঘটনার পরদিন ৭ নভেম্বর এলাকায় গিয়েছিলেন এবং ৮ নভেম্বর মাদারপার ও জয়পুর পাড়ার সাওঁতাল পল্লীর ৫০টি পরিবারে ত্রাণ বিতরণ করেন বলে জানান তিনি।
উচ্ছেদ অভিযান অস্বীকার :
সেদিন পুলিশ ও প্রশাসনের উপস্থিতিতে সাঁওতাল পল্লীর ঘর বাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হলেও কোনো উচ্ছেদ অভিযান চালানোর কথা স্বীকার করেননি দায়িত্বশীল কেউ। কর্মকর্তারা সবাই দায় দিচ্ছেন গ্রামবাসীকে। আবার ঘর লুটপাট-অগ্নিসংযোগে বাধা দিতে প্রশাসনের কোনো চেষ্টাও ছিল না বলে সাঁওতালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
সংঘর্ষের বিষয়ে রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বীজ হিসেবে সংগ্রহের জন্য গত রোববার (৬ নভেম্বর) চিনিকলের রোপণ করা আখ কাটতে গেলে সাঁওতালরা বাধা দেয় এবং এরপর মিলের শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের সঙ্গে সাঁওতালদের সংর্ঘষ বাধে।
“এক পর্যায়ে সাঁওতালরা পুলিশ ও চিকিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর তীর নিক্ষেপ করে। এতে ৯ পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন তীরবিদ্ধ হলে স্থানীয় জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।”
তিনি দাবি করেন, মিলে জমিতে বসতি গাঁড়ার পর সাঁওতালরা স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করতে থাকে। সব মিলে সেদিন স্থানীয় গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে তাদেরকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে।
গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, সংর্ঘষে ৯ পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন তীরবিদ্ধ হলে পুলিশ ওই এলাকায় আসামি গ্রেপ্তার করতে যায়। এর কোনো এক সময় স্থানীয় গ্রামবাসী সাঁওতালদের ঘরগুলোতে আগুন দেয়। পুলিশ কোনো উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেননি বলে দাবি করেন তিনি।
পুলিশ আসামি ধরার কথা বললেও ওই ঘটনার পরে ৩৮ জনের নাম উল্লেখসহ সাড়ে ৩শ’ জনকে আসামি করে মামলা করে। কিন্তু সাঁওতাল নিহতের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিকালে পুলিশ ওই এলাকায় আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। ওই সময় পাশের ৭/৮ গ্রামের লোক দখলদারদের একচালা ঘরগুলো পুড়িয়ে দেয়। তিনি তখন ওই এলাকায় কর্তব্যরত ছিলেন মাত্র, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেননি বলে দাবি করছেন।
ইউএনও বলেন, “ইক্ষু খামারের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমির মধ্যে আখ চাষের পর অনেক জমি পরিত্যক্ত থাকে। পরিত্যক্ত ওই জমিতে স্থানীয় গ্রামবাসী গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়ায়। আবার কেউ কেউ ওই ঘাস কেটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু সাঁওতালরা দখল করার পর গ্রামবাসীকে ওই পরিত্যক্ত জমিতে আসতে দিত না। সেই ক্ষোভ থেকে তারা এ কাজ করেছে।”
সূত্র: