সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
সম্প্রতি একটি মিডিয়া এজেন্সি থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় একটি সামাজিক ইস্যুতে সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে। আমি রাজি হওয়ার পর নির্দিষ্ট দিনে হাজির হলেন বেশ সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। দুজনেরই বয়স পঁচিশের মধ্যে। মেয়েটিই এত দিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন টেলিফোনে। প্রতিবারই তিনি ইংরেজিতে কথা শুরু করায় এত দিন ইংরেজিতেই আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। আমি ধারণা করেছিলাম, মেয়েটি হয়তো দেশের বাইরে বড় হয়েছেন; কিংবা হয়তো বাংলা জানেন না। কিন্তু সাক্ষাৎকার গ্রহণের দিনে মেয়েটিকে দেখে কেন যেন সন্দেহ হলো আমার। প্রশ্ন করলাম, ‘বাংলা বোঝেন?’ মেয়েটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। তারপর আরেকটু সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাংলা বলতে পারেন?’ মেয়েটি স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দিলেন, ‘জি, পারি।’ তাঁর উত্তর শুনে খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললাম, ‘আসুন, তবে বাংলাতেই কথা বলি।’
বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা। অন্যদিকে ইংরেজি বিশ্বের সবচেয়ে পছন্দের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার অর্থ হলো যখন দুটি দেশের দুটি ভিন্ন ভাষার মানুষকে একটি জানা ভাষার ওপর নির্ভর করতে হয় মনের ভাব আদান-প্রদান করার জন্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একজন চায়নিজ ও একজন ইতালিয়ান নাগরিক যখন একত্র হয়, তখন তারা তাদের নিজস্ব ভাষা বা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে না পেরে নির্ভর করে এমন একটি ভাষার ওপর, যা দুজনের কাছেই বোধগম্য। ভাষাটি হতে পারে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা। তাই অবাক হই, যখন আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা নিজস্ব ভাষা থাকার পরও নিজস্ব পরিসরে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য অকারণে শরণাপন্ন হই অন্য কোনো লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার ওপর।
আজকাল বিনা প্রয়োজনে অফিসপাড়ায়, লিফটে, সভা-সেমিনারে, এমনকি শিশু-কিশোরদের আড্ডায় বাংলা ভাষাকে দূরে সরিয়ে ইংরেজিকে কাছে টেনে নেওয়ার প্রবণতা প্রকটভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। কোনো কোনো সভায় লক্ষ করেছি ৯৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বাংলা ভাষাভাষী হওয়ার পরও ১ শতাংশ ভিনদেশি থাকায় পুরো সভা ইংরেজিতে পরিচালনা করা হচ্ছে। এমনকি শতভাগ বাংলাদেশি থাকার পরও পুরোপুরি ইংরেজি ভাষায় ফোরাম পরিচালিত হতে দেখার অভিজ্ঞতাও বিরল নয়। এতগুলো মানুষের স্বস্তি ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে ব্যাহত করে কেন ফোরামগুলো ইংরেজিতে পরিচালনা করতে হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অথচ পরিস্থিতি বিবেচনা করে দোভাষীর মাধ্যমে সহজেই সব অংশগ্রহণকারীর স্বস্তিদায়ক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। এতে সভাগুলো আরও প্রাণবন্ত ও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। মজার বিষয় হচ্ছে বিশ্বের ৪০ কোটির কম মানুষের নিজস্ব ভাষা ইংরেজি। কিন্তু এই ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের ফলে নিজ ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে ১৫০ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই লক্ষ করছি ছোট ছোট শিশুদের বাংলা নয়, বরং ইংরেজিতে বলা সংলাপ, গল্প, কিংবা ছড়া-কবিতা প্রায়ই আপলোড করছেন গর্বিত পিতা-মাতা। তাদের কথা শুনে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। আমরা ফিরে তাকাচ্ছি নিজেদের সন্তানের দিকে। অতঃপর ইংরেজি বলার সেই দক্ষতা নিজের সন্তানের মধ্যে খুঁজে না পেয়ে সন্তানকে দোষ দিচ্ছি, দোষ দিচ্ছি নিজেদের। এরপর বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ছি সন্তানকে ইংরেজি শেখানোর যুদ্ধে। অপ্রয়োজনে বিপণিবিতানে, পার্কে, রাস্তায়, খেলার মাঠে কথা বলছি ইংরেজিতে।
অন্যদিকে চাকরিযুদ্ধে ইংরেজি ভাষা না জানলেই নয়। জ্ঞানের গভীরতা যা-ই হোক না কেন, ইংরেজি ভালোভাবে বলতে পারার সক্ষমতা অনায়াসেই আজকাল কাটিয়ে দিতে পারে অনেক অক্ষমতা। কেউবা আবার আধো বাংলা আর আধো ইংরেজিতে রপ্ত করে নিয়েছেন বিকৃত ও বিরক্তিকর একধরনের ভাষা। ‘বাংলা ভালো জানি না’ বলতে পারাটাও বোধ হয় একধরনের যোগ্যতা হয়ে উঠেছে আজকাল। মাতৃভাষা পড়তে, বলতে কিংবা লিখতে পারার দক্ষতা হারিয়ে আমরা হাসছি বিজয়ীর হাসি। ইংরেজি ভাষায় অদক্ষতা যদি ক্যারিয়ারের জন্য অনেক বড় একটি প্রতিবন্ধকতা হয়, তবে মাতৃভাষা ভালোভাবে না জানাটা কেন আজ বাড়তি পালক হিসেবে ক্যারিয়ারে যোগ হবে?
মনে রাখা প্রয়োজন, ইংরেজি ভাষাটি তার আধিপত্য ধরে রাখতে পেরেছে মূলত বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দুটো দেশ; যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভাষা হওয়ায়। ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার হিসেবে উঠে এসেছে চীন। তাই অদূর ভবিষ্যতে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কী! কারণ, এখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীদের চীনা ভাষা শেখার হার ক্রমাগত বাড়ছে। তার ওপর রয়েছে আবার প্রযুক্তির সহজলভ্যতা। আজকাল ভাষা অনুবাদ, কণ্ঠ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী রোবট প্রযুক্তি যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে অন্য কোনো ভাষা শেখার প্রয়োজন না-ও হতে পারে। প্রযুক্তিই হয়তো সেই ঝামেলা থেকে মানুষকে দ্রুত মুক্তি দিতে চলেছে। তাই ইংরেজি ভাষাকে ধ্যানজ্ঞান করে বসে থাকার প্রবণতা যে সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে না, এমন ভরসা নেই।
ভাষা শুধুই যোগাযোগের মাধ্যম নয়; বরং ভাষা একজন মানুষের পরিচয়কে তুলে ধরে। অনেক সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের বাংলা ভাষা। মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াকালীন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত কবীর চৌধুরী, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কিংবা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের কখনো শ্রেণিকক্ষের বাইরে অকারণে ইংরেজি বলতে শুনিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা আমাদের নিজেদের ভাষাকে আজও সঠিকভাবে মর্যাদা দিতে শিখিনি। মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার অর্থ শুধুই একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দেওয়া কিংবা সাদা-কালো পোশাকে সজ্জিত হয়ে সেলফি তোলা আর ফেসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দেওয়া নয়। বরং ভাষার মর্যাদা বলতে বোঝায় শুদ্ধভাবে ভাষার চর্চা এবং সর্বস্তরে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা।