সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
কোন মানুষের শরীরের রং বা গড়ন নিয়ে আড়ালে অথবা প্রকাশ্য নেতিবাচক মন্তব্য করে ওই ব্যক্তিকে অসম্মান করার প্রবণতা আছে সমাজের অনেকের মধ্যেই।
তবে এই কটূক্তি যদি আসে পরিবার থেকে তাহলে এর প্রভাব ওই ব্যক্তির ওপর ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।
সমাজের বেঁধে দেয়া সুন্দরের সংজ্ঞায় যারা পড়েন না, যাদের গায়ের রং শ্যামলা বা কালো, ওজন অতিরিক্ত বেশি- কম অথবা শারীরিক গড়নে কোন ক্রুটি আছে – তাদের এ নিয়ে কখনও কটূক্তি শুনতে হয়নি, এমন নজির নেই।
কুমিল্লার একটি সরকারি স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা তাঁর এমন বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা বলেন। সেজন্য কিশোর বয়সে আত্মহত্যারও চেষ্টা করছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমি ছোট থাকতে দেখতে কালো আর মোটা ছিলাম। তো বাসা থেকেই বলতো এই তুই রাতে এখন থেকে আর খাবি না। এমনও হয়েছে যে আম্মা আমার জন্য রং ফর্সা করার ক্রিম নিয়ে আসছে।”
নিজ পরিবারের এমন আচরণ ভেতরে ভেতরে তাকে কুড়ে খেত। ছোটবেলা থেকে তিনি এমন ধারণা নিয়েই বড় হয়েছেন যে নিশ্চয়ই তার মধ্যেই কোন কমতি আছে। যা কিনা কাজ পড়ালেখায় বিরূপ প্রভাব ফেলছিল।
“কয়েকবার আমি আত্মহত্যার ট্রাই করে ছিলাম। একসময় আমার মনে হয়েছিল যে আমার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকারই কোন দরকার নাই। ভেবেছিলাম আমি হয়তো মরে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সে ব্যক্তি।
নারীদের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা যেন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক নারী, যিনি ভাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অভিজাত পরিমণ্ডলে বড় হলেও প্রতিনিয়ত শরীরের দাগ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের নানা কথার মুখে পড়তে হয়েছে।
এমন অবস্থায় মানুষের মুখোমুখি হতেই ভয় পান এই নারী।
তিনি বলেন, “আমার স্কিনে কিছু দাগ রয়েছে। এটা নিয়ে আমার পরিবার আর কাছের দূরের আত্মীয় স্বজন অনেকেই অনেকভাবে বলতো যে, বিয়ে কিভাবে দেবে? যদিও বিয়েও হয়, শ্বশুড়বাড়ির লোকজন একসেপ্ট করবে কিভাবে? আমি কখনো চাকরি পাবো? আরও অনেক কথা।”
“নিজেকে যখন আয়নায় দেখতাম, খুব কষ্ট পেতাম এটা নিয়ে প্রতিবাদ করার কোন আত্মবিশ্বাসও আমার থাকেনা। কিন্তু এখন আমার একটা মেয়ে আছে। তাকে কখনও কেউ এ ধরণের কথা বললে আমি ছাড় দেব না। কারণ আমি নিজে এই সময়টা দিয়ে পার হয়েছি। আমি জানি যে এটা কতো কষ্টকর,” বলেন সে নারী।
মানসিক প্রভাব:
অনেক পরিবার মনে করে গায়ের রং বা ওজন নিয়ে কটূক্তি নিছক হাসি-ঠাট্টার বিষয়, এতে কোন ক্ষতি নেই।
কিন্তু এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা হোসেন।
তাঁর মতে একেকজন মানুষের মানসিক গ্রহণযোগ্যতা একেক রকম।
এসব কথায় অনেকে হীনমন্যতা, বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকে। যেটি এক পর্যায়ে মানসিক অসুস্থতা, মাদক সেবন, অসৎ সঙ্গ কিংবা আত্মহত্যার প্রবণতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
একে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বডি শেমিংটা প্রতিমুহূর্তে এতো বেশি হারে হচ্ছে যে অনেকেই সুইসাইডাল হয়ে পড়ছেন। পরিবার থেকেই যখন তাকে কটূক্তি করা হয় তখন সে কোথায় যাবে কোথায় নিজেকে গ্রহণযোগ্য করতে পারবে, সেই জায়গাটা সে খুঁজে পায়না।”
“এতে তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অন্যকে সম্মান করার প্রবণতা কমে যায়।”
পরিস্থিতি পরিবর্তনে পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যের, কারও শরীরের গড়ন নিয়ে কিছু না বলার অভ্যাস গড়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সমাজ ও পরিবারের ভূমিকা:
পরিবারের এই গুরুত্বের কথা স্বীকার করছেন সমাজ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরাও।শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম স্তরেই রয়েছে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল পরিবার।
কিন্তু এই পরিবার থেকেই যদি এই প্রতিনিয়ত কটূক্তি শুনতে হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ।
“সমাজ যদি কোন বিরূপ মন্তব্য করে তাহলে, তখন সেই আঘাত নিবারণের দায়িত্ব পরিবারের। কিন্তু আমরা দেখি উল্টো। বাস্তবে পরিবারের সদস্যরা ঠিক ওইভাবেই কটাক্ষ করছে। এটা এমন এক মানসিক চাপ তৈরি যে তার কাছে মনেহয় যেন এর চাইতে দুরারোগ্য কোন ব্যাধি বা মৃত্যু বরণ করাই শ্রেয়,” বলেন মিজ ইরশাদ।এমন অবস্থায় পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে আরও সচেতন ভূমিকা হওয়ার কথা জানান তিনি।
“আমাদের সমাজে শিক্ষার ব্যাপ্তিটা এখনও সব পর্যায়ে সেভাবে হয়নি। এ কারণে এটা সমাজ থেকে উঠে যায়নি বরং আরও বেড়ে গেছে। পরিবারের এক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়া উচিত।”
অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদের মতে গোটা বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতা মহামারী আকার ধারণ করায় মানুষের আত্মসম্মানবোধের চাইতে প্রাধান্য পাচ্ছে সৌন্দর্যের সেই বাঁধাধরা ছক।
আর পরিবারের সহায়তা না থাকায় সেই ছকেই বাঁধা পড়ছেন কটূক্তির শিকার মানুষগুলো।