সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
প্রায় ৩৪ বছর পর চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠনের কমিটি ঘোষণার পরপরই সোমবার রাতে কলেজ এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হয়। গতকাল মঙ্গলবারও দফায় দফায় মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে কমিটিবিরোধীরা। নতুন কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে তারা বলেছে, অন্যথায় পাল্টা কমিটি করা হবে।
ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, ২৫ সদস্যের যে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে জামায়াত সমর্থক ছাত্রশিবিরের নেতাও ঠাঁই পেয়েছেন। রাখা হয়েছে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের নেতাকেও।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতার অভিযোগ, ৪০-৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে কলেজ কমিটিতে বিতর্কিতদের স্থান দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে মামলার আসামিও আছে। তবে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন কমিটি অনুমোদন করা চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের নেতারা।
উল্লেখ্য, প্রায় তিন দশক পর ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ আবার নিয়ন্ত্রণে আসে ছাত্রলীগের। ওই দিন ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল।
কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি : দীর্ঘদিন পর ২০১২ সালে কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। কিন্তু সংগঠনের একটি অংশ সেই কমিটি মানেনি। এ নিয়ে বিরোধ ছিল। একাধিকবার সংঘর্ষও হয়েছিল। এরপর দুই বছরের বেশি সময় ধরে ছাত্রলীগ নতুন কমিটি করার জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় গত সোমবার রাতে হঠাৎ করে নতুন কমিটির আংশিক ঘোষণা করা হয়। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে যথাক্রমে মাহমুদুল করিম ও সুভাষ মল্লিক সবুজকে।
মাহমুদুল নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (প্রয়াত) এবং সবুজ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসির অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সহসভাপতি মোস্তফা কামালসহ কয়েকটি পদে নাম রয়েছে সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া ৯ জন সহসভাপতি, চারজন যুগ্ম সম্পাদক, চারজন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং অন্য ছয়জনকে বিভিন্ন পদে রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর কমিটি অনুমোদন দেন। জাকারিয়া বিষয়টি কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। ১০১ সদস্যের এই কমিটির বাকিদের পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে তিনি জানান।
চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের হাতাহাতি। ছবি : কালের কণ্ঠ
কমিটিতে শিবির-ছাত্রদল নেতা : জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধ মেটানোর লক্ষ্যে সোমবার দুপুরে সিটি করপোরেশন সম্মেলন কক্ষে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র নাছির উদ্দীন, একই কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নগর আওয়ামী লীগ নেতারা। এ অবস্থায় ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম কলেজ শাখার এই নতুন কমিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, নির্বাচনের আগে চট্টগ্রাম কলেজের নতুন এই কমিটি নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যেও বিরোধ দেখা দিতে পারে। এ ধরনের কমিটি করে চট্টগ্রামে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চলছে। বিএনপি নেতার ছেলে ছাত্রদল নেতা এবং শিবিরের সাথী দিয়ে কমিটি হলে বিশৃঙ্খলা ছাড়া ছাত্রলীগে আর কিছুই হবে না।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জানান, চট্টগ্রাম কলেজ শাখার নতুন কমিটিতে উপশিক্ষা ও পাঠক্রম সম্পাদক পদ পেয়েছেন রিফাত হোসেন। রিফাতের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া। তিনি পেকুয়া কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বাবা পেকুয়া সদর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন খালেদ মাহমুদ চৌধুরী টুটুল। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতির পদ পেয়েছেন। একই কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন কলেজের ‘ছাত্রশিবিরের সাথী’ হিসেবে পরিচিত খাদেমুল ইসলাম দুর্জয়। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের সংঘর্ষের পর দুর্জয়কে ওই দিন ছাত্রলীগ নেতারা পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন। এ ছাড়া নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই, বয়স বেশি, অন্য কলেজের ছাত্রসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
নতুন কমিটির সহসভাপতি মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্জয়কে আমরা শিবিরের সাথী হিসেবে ওই সময় পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছিলাম। খালেদ ও রিফাত ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। অথচ ছাত্রলীগের রাজনীতি করার কারণে যাঁরা শিবিরের হামলার শিকার হয়েছেন তাঁদের অনেককে কমিটিতে রাখা হয়নি। অন্য কলেজের ছাত্রকেও কমিটিতে রাখা হয়েছে।’
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসম্পাদক ইয়াছিন আরাফাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ইতিমধ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আগামী নির্বাচনের আগে নতুন কোনো কমিটি না করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের নেতারা (আওয়ামী লীগ) নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে বৈঠক করছেন। কিন্তু তাঁদের এবং ছাত্রলীগের অনেক নেতাকে না জানিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের এই কমিটি দেওয়া হয়েছে।’
নগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব কিছু দেখে এবং সবার সঙ্গে কথা বলে আমরা গ্রহণযোগ্য একটি কমিটি দিয়েছি। কমিটির পরিধি সপ্তাখানেকের মধ্যে আরো বাড়ানো হবে। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নতুন কমিটির সভাপতি মাহমুদুল করিম দাবি করেন, দুর্জয় শিবিরের সাথী ছিলেন না। যাঁরা পদ-পদবি পাননি তাঁরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছেন নতুন কমিটিকে বিতর্কিত করতে। ছাত্রদল ও শিবিরের কেউ এই কমিটিতে নেই।
রিফাত হোসেন বলেন, ‘আমি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। এই অভিযোগ মিথ্যা।’
কমিটি নিয়ে বিক্ষোভ, অবরোধ : সোমবার রাত ১১টার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমিটি করার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই বিক্ষোভ শুরু করে পদ পাওয়াদের মধ্যে কয়েকজন এবং পদবঞ্চিত নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা। রাত ৩টা পর্যন্ত তারা চট্টগ্রাম কলেজের আশপাশ এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। গতকাল সকালে আবার রাস্তায় নামে তারা। নগরের গণি বেকারি মোড় থেকে কলেজ হয়ে প্যারেড মাঠ এলাকা (কেয়ারি মার্কেট) পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী দফায় দফায় মিছিল সমাবেশ করেছে। তারা চট্টগ্রাম কলেজের সামনে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড দেয়। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এ সময় দফায় দফায় কমিটি সমর্থকদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে। কয়েকটি ককটেলও বিস্ফোরিত হয়। কয়েকজন কর্মীর হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে আন্দোলনকারীরা সড়ক থেকে ব্যারিকেড তুলে নিলেও সড়কের বিভিন্ন স্থানে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে মিছিল করেছে তারা। অন্যদিকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নতুন কমিটির পক্ষে আনন্দ মিছিল হয়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম কায়সার উদ্দিন বলেন, ‘ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়নি। নতুন এই কমিটি আমরা মানি না। সবাইকে নিয়ে গ্রহণযোগ্য কমিটি করা না হলে আজ (গতকাল) অথবা কালকে (আজ) আমরা নতুন কমিটি ঘোষণা করব।’
চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফ হোসেন জানান, বিক্ষোভকারীদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।