নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে তখন জলিকে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। আমি তাকে কখোনও আকতার জাহান বলিনি, শুধু জলি বলতাম। প্রতিদিন আমার খোঁজ নিত। আমি ওষুধ খেয়েছি কিনা, কতদিন ধরে খাচ্ছি, অন্য কোনও সহকর্মী এটা করে না। জলি শুধু যে আমার সঙ্গেই এমনটা করে, তা নয়। সবার সাথে পেশার বাহিরে ব্যক্তি সম্পর্ক রেখে গেছে জলি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলি স্মরণে শোকসভায় গুমরে ওঠা কান্না চেপে এসব কথা বলছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের প্রশাসক অধ্যাপক মশিহুর রহমান। রবিবার দুপুর ১২টার দিকে বিভাগের ১২৩ নম্বর কক্ষে এ সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় আকতার জাহানের বড় বোন ইসরাত জাহান বলেন, আমরা দ্ইু বোন এক সাথে বড় হয়েছি। পিঠাপিঠি ছিলাম তো। আমি দেশের বাহিরে ছিলাম। যাবার আগে সোয়াদকে (আকতার জাহানের ছেলে) নিয়ে আলোচনা হয়েছে যে, গণিতে সে একটু দুর্বল ছিল, কীভাবে সে ভালো করবে। যার বাচ্চাকে নিয়ে এত উদ্বিগ্নতা, সে এ ধরনের একটা…আর কিছু বলতে পারেননি তিনি।
জলির মৃত্যুর বিচার চেয়ে ছোট ভাই কামরুল হাসান বলেন, আমার বোন মারা গেছে, তাকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু তার মৃত্যুর কারণ, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক যে চিত্র সেটা সবার সামনে আসবে, এটাই আমি আশা করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহ্ আজম বলেন, আমরা কেন আকতার জাহানের অভিমান বুঝতে পারিনি, এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা। এ মৃত্যুতে যদি কোনও প্ররোচনাকারী থাকে তার বিচার চাই। তিনি শুধু আকতার জাহানকে হত্যা করেননি, তার স্বপ্নকে হত্যা করেছেন।
সভায় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফয়জার রহমান বলেন, তিনি স্পষ্ঠভাষী ছিলেন। কথাবার্তা, আচার-আচরণে অমায়িক ছিলেন। এখন আমাদের একটাই করণীয়, তার নীতি আদর্শের ভালো গুনগুলো আমাদের ধারণ করতে হবে। তাহলে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা বলেন, আমি তাকে জলি হিসেবেই সবসময় হাসিখুশি দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। কী পরিস্থিতি তৈরি হলে একটা মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে তা আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। কোনও মানুষ একবারে একাকি না হলে আত্মহত্যার দিকে যেতে পারে না। আমারা জলির মৃত্যুর দায় এড়াতে পারি না।
বিভাগের সভাপতি ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে বলেন, জলি আপার মৃত্যু আমাকে দুইভাবে বিধ্বস্ত করেছে, ব্যক্তি হিসেবে, বিভাগের সভাপতি হিসেবে। দায়টা আমার একটু বেশি। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছি।
এদিকে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীর বিচার চেয়ে তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী সভায় বলেন, প্রতিটা ক্ষেত্রে সবাইকে আগলে রেখেছিলেন তিনি, যেমনটা মা করতেন। মেয়েদের বলতেন, তোমরা স্বার্থপর হও, তাছাড়া টিকতে পারবে না।
মাস্টার্সের শিক্ষার্থী জোবায়দা শিরিন জ্যোতি বলেন, যে শিক্ষার্থীরা খরচ চালাতে পারে না, ম্যাম তার বেতনের একটা অংশ ওই শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় ব্যয় করতেন। ম্যাম কখোনও মচকায়নি, তাকে ভেঙ্গে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা বিচার চাই।
বিভাগের সভাপতি ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য দেন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেত্রী মাহবুবা কানিজ কেয়া, মহিলা পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাধুরী রায় চৌধুরী প্রমুখ। সভা চলাকালে আকতার জাহান জলিকে নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শণ করা হয়। সেসময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কান্না চেপে রাখতে পারেননি।
এর আগে সাড়ে ১১টায় বিভাগের সামনে থেকে একটি শোকর্যালি বের করা হয়। র্যালি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ পুনরায় সেখানে ফিরে আসে। এসময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কালোব্যাজ ধারন করেন।
৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের নিজ কক্ষ থেকে আকতার জাহানকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
স/অ