সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
আগে কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটলেও ২০০৫ সালের আগে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার খবর তেমন আলোচনায় ছিল না; কিন্তু ওই বছরের ১৭ অগাস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গিরা জানান দিয়েছিল যে তারা কতটা সক্রিয়।
শুরুতে অস্বীকার করে এলেও তারপর জেএমবি নামে জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিলে প্রশাসনকেও নড়েচড়ে উঠতে হয়। জেএমবিসহ চারটি দল নিষিদ্ধ এবং শীর্ষ জঙ্গিনেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুরও তুলতে শুরু করেছিল।
কিন্তু ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ আন্দোলন গড়ে ওঠার পর তার বিপরীতে ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ শাস্তির দাবিতে হেফাজতে ইসলামের সক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে একটির পর একটি হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে।
২০০৫ সালের বোমা নিয়ে হামলার পর চাপাতি ও ধারাল অস্ত্রে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, পুরোহিত, যাজক, শিয়াদের উপর বিচ্ছিন্ন হামলার পর এই বছর গুলশানে কূটনীতিক পাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে এক হামলায় ১৭ বিদেশিকে হত্যার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ।
এর মধ্যেই নতুন নতুন দলের খবর আসে, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে জঙ্গিদের পারদর্শিতাও উন্মোচিত হয়, হামলার পর নানা নামে ইন্টারনেটে বার্তাও আসতে থাকে, আইএস কিংবা আল কায়দার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর নামে হয় দায় স্বীকারও; তবে ১১ বছর পর ঘুরেফিরে আবার ফিরে এসেছে ২০০৫ সালের সেই জেএমবির নামই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সেই জেএমবি কয়েকটি ধারায় ভাগ হওয়ার পর তার একটি এখন ‘নিউ জেএমবি’ নামে সক্রিয় এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমসহ কয়েকটি সংগঠন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সাম্প্রতিক ধারার শুরুটা হয়েছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বা হুজির মধ্য দিয়ে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে তালেবান বাহিনীর হয়ে লড়াই চালিয়ে আসা বাংলাদেশিরাই এই সংগঠনটি গড়ে তোলেন।
‘আমরা সবাই তালেবান-বাংলা হবে আফগান’ এই স্লোগানে মিছিল তিন দশক আগে বাংলাদেশে দেখা গেলেও হুজির তৎপরতা তখনও প্রকাশ্য ছিল না।
এরপর ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলন, ২০০১ সালে পল্টনে সিপিবির সমাবেশ ও রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান, গোপালগঞ্জে গির্জা এবং নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা হলেও এসব ক্ষেত্রে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার খবরটি পুলিশের তদন্তেও আসেনি।
একইভাবে বইমেলার বাইরে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ইউনুসের উপর হামলা হলেও তার পেছনে যে সংঘবদ্ধ জঙ্গিরা রয়েছে, তা তখন পর্যন্ত ছিল অজানা। আর তখন হামলার দায় স্বীকার করে কোনো সংগঠনের কোনো ধরনের বার্তাও আসেনি।
২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলা চালানোর সময় প্রতিটি স্থানে প্রচারপত্র রেখে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি। গত শতকের ৯০ দশকে গঠিত এই দলটি প্রকাশ্যে আসার আগে রাজশাহীর বাগমারায় এক ধরনের মহড়াও দিচ্ছিল বলে গোয়েন্দারা বলছেন।
১৭ অগাস্ট বোমা হামলার পর ঝালকাঠীতে বিচারক ও গাজীপুর আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন এলাকায় আদালত লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে জেএমবি। বাংলাদেশে আত্মঘাতী হামলা এই জেএমবির মধ্য দিয়েই শুরু হয়।
ঝালকাঠীর দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসি কার্যকর হয় আমির শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ জেএমবির ছয় শীর্ষনেতার। এরপর প্রকাশ্য তৎপরতা কমে আসে এই সংগঠনটির।
আগে শুধু আদালত লক্ষ্য করে হামলা হলেও ২০১৩ সালের পর হামলার ধরন বদলে শুরু হয় গুপ্তহত্যা। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত করে একের পর এক হামলা হতে থাকে; সেটা কখনও নির্জন রাস্তায়, কখনও ব্যস্ত সড়কে, কখনও বাড়িতে, কখনও কার্যালয়ে।
অসাম্প্রদায়িক লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা এবং সবশেষে বিদেশিরা।
শুরুতে গ্রেনেড ও বোমা হামলা চালিয়ে হামলার যে প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল, তা থেকে ধারাল অস্ত্র ব্যবহারের পর এখন দেখা যাচ্ছে একে-২২ রাইফেল, পিস্তলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র।
তখন জঙ্গি হিসেবে মাদ্রাসা ছাত্রদের নাম এলেও এখন বিদেশ থেকে পড়ে আসা এবং দেশের নামি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদেরও দেখা যাচ্ছে এই ‘নব্য জেএমবিতে’। আধুনিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠা স্বচ্ছল পরিবারের এই তরুণ-যুবকদের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতায় গোয়েন্দারাও হিমশিম খাচ্ছেন।
জঙ্গিদের আক্রমণের ধরন বদলানোর বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, “জঙ্গিবাদের ধরন বদলাচ্ছে, কারণ আগে আন্তর্জাতিক অবস্থাটা এই রকম ছিল না।”
এটা মোকাবেলার উপায় কী- প্রশ্ন করা হলে সাবেক এই পুলিশ প্রধান বলেন, “এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভাল রকমের গোয়েন্দা তথ্য দরকার। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট করা হয়েছে, এটা ভালো।”
পুলিশের চোখে নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশকে মেরে তিন জেএমবি নেতাকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেওয়ার পর নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। তারপর গত ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর পুলিশ জানায়, কানাডা প্রবাসী তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে সক্রিয় আছে এখন ‘নিউ জেএমবি’।
সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমি যতদূর জানি, জেএমবি এখন তিনভাগে বিভক্ত। একটা গ্রুপ হচ্ছে, ওল্ড জেএমবি। এই ধারার মূল নেতাদের ফাঁসি হয়েছে। এই গ্রুপ খুব বড় নয়। পুলিশের বক্তব্য অনুসারে অন্য একটি গ্রুপ বেশ শক্তিশালী মনে হয়।”
বাংলাদেশে আইএস তার শাখার প্রধান হিসেবে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের নাম ঘোষণা করেছিল বলে তাদের কথিত সাময়িকী দাবিক-এ খবর প্রকাশ হয়েছিল; তামিম চৌধুরীই সেই ব্যক্তি বলে অনেকে মনে করছেন।
সাখাওয়াত বলেন, “এই দুই ব্যক্তি এক কি না, সেটা আমি বলতে পারব না। মনে হয় তামিম চৌধুরী আইএস সংযুক্ত অংশের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে সংযুক্ত। এটা যদি জেএমবির অংশ হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত তিনিই এই অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
“তিনি যদি জেএমবির এই অংশের নেতৃত্বে থেকে থাকেন, তাহলে এ সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংগঠিত জেএমবি। যার সঙ্গে পুরাতন জেএমবির কোনো সম্পর্ক নাই।”
“তামিম চৌধুরীর যে অংশটা রয়েছে, এরা মূলত ইন্টারনেট প্রজন্ম। তবে তাদের সঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। সমাজের পৃথক দুই ধারার এই সমন্বয়ও বেশ বিস্ময়কর।”
জেএমবির তৃতীয় ধারাটি আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সঙ্গে একীভূত হয়ে থাকতে পারে বলে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা মনে করেন।
“আনসারুল্লাহ বাংলা টিম খুব সম্ভবত প্রশিক্ষণ, সাইবার ওয়ারফেয়ার ইত্যাদি কাজে তাদের প্রকাশ্য নাম। বৈশ্বিকভাবে আনসার আল ইসলাম মূলত আল কায়দা থেকে জন্ম নেওয়া। এটা ইরাকভিত্তিক। এক পর্যায়ে তারা দুই ভাগ হয়ে যায়। যার একভাগের নেতৃত্বে ছিলেন আবু মুবাব আল জারকাবি, যারা পরে আইএস হয়ে যায়। অন্যভাগ হচ্ছে সিরিয়ার আল নুসরা ফ্রন্ট।”
আইএসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে সাখাওয়াত বলেন, “আইএস দুইভাবে কাজ করে। একটা হচ্ছে, তারা বেলায়েত ঘোষণা করে। বেলায়েত মানে হচ্ছে প্রদেশ। মিসর, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় তাদের তিনটি বেলায়েত রয়েছে। এ সব জায়গায় কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের সরাসরি লিঙ্ক রয়েছে।
“অন্য সব জায়গায় স্থানীয় গ্রুপ কাজ করছে। যেমন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কাভিতা মুসানতারা।”
বাংলাদেশের এই জঙ্গিদের বিষয়ে সাখাওয়াত বলেন, “হয়ত এরা স্থানীয়ভাবে কাজ করছে, যাদের আইএসের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রয়েছে। আইএসের শাখা হতে কাজ দেখানোর অংশ হিসাবে তারা নতুন নতুন হামলা করছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনের মতে বাংলাদেশের নতুন ধারার জঙ্গিবাদী দলটিকে আইএস না বলে ‘নব্য জেএমবি’ বলাই যুক্তিযুক্ত।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে যখন হামলা হয় তখনও আইএস তার দায় স্বীকার করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সেই হামলাকারীদের সাথে তারা আইএসের কোনো সংযোগ খুঁজে পায়নি। ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে, এরা মূলত আইএস দ্বারা উৎসাহিত হয়েছে।
“পৃথিবীর যেখানেই সন্ত্রাসবাদী ধরনে কোনো আক্রমণ হয়, তার দায় স্বীকার করা আইএসের একটা প্রবণতা হয়ে গেছে।”
ভীতি ছড়ানোর জন্যও স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নাম ব্যবহার করতে পারে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
এদের আইএস না বলার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আইএস সাধারণত নির্বিচারে হত্যা করে। সুযোগ পেলেই তারা হামলা করে।
“বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন তারা বিদেশিদের মারছে? মাইনোরিটির লোকজনদের মারছে? মাইনোরিটির উপর হামলা হলে ভারত; খ্রিস্টানদের উপর হামলা হলে পশ্চিমারা; জাপানিদের উপর হামলা হলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশটি উদ্বিগ্ন হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এগুলোর সবগুলোই একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।”
বাংলাদেশে ইসলামের নামে এই ধরনের তৎপরতা সফল হবে না বলে মনে করেন দেলোয়ার।
“বাংলাদেশের ভোটিং প্যাটার্ন দেখলেই বোঝা যাবে, সবচেয়ে বড় ইসলামি দলটাও কিন্তু বড় জোর ৫ শতাংশ পায়। এটা থেকেই বোঝা যায়, এখানে জনগণের মাঝে এই ধরনের সন্ত্রাসের কোনো স্থান নাই।”
“তারা আফগানিস্তানে কিছু চাইলে করতে পারে, কারণ সেখানে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা স্বল্পকালীন লক্ষ্যকেন্দ্রিক কার্যক্রমই মনে হয়, যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।”
সূত্র: বিডি নিউজ