স্থাপত্যশৈলীতে ভরা ঐতিহাসিক শাহ মখদুম ঈদগাহ যেন সম্প্রীতির মেলবন্ধন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রমত্তা পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে রাজশাহী নগরী। এই পদ্মার পাড়েই গড়ে উঠেছে শাহ মখদুম (রা:) স্মৃতি বিজড়ীত ঈদগাহ ময়দান বা ঈদগাহ মাঠ। শহররক্ষা বাঁধের উত্তরপাশেই আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর হযরত শাহ্ মখমুদ রুপোষ (রহ.) কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দান। বছরের পর বছরজুড়ে রাজশাহীর এ ঐতিহাসিক ঈদগাহ ময়দানটি যেন আজো নেতৃত্ব দিয়ে আসছে এ অহঞ্চলের। নগরীর প্রাণকেন্দ্রের পাঠানপাড়ায় এই বিশাল ঈদগাহ ময়দানে প্রতিবছর লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, হযরত শাহ্ মখদুম রুপোষ (রহ.) ১২১৬ (হিজরি ৬১৫ সালের ২ রজব) সালে ইরাকের বাগদাদ শহরে এক বিখ্যাত সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত আলী (রা.) বংশধর এবং বড়পীর হযরত আব্দুর কাদির জিলানী (রহ.)-এর নাতি (পুত্রের পুত্র) ছিলেন। ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারের জন্য ১২৮৯ সালে ভারতবর্ষ হয়ে মহাকালগড়ে (রাজশাহীর তৎকালীন নাম) আসেন ধর্ম প্রচার করতে। তৎকালীন সামন্তরাজ কাপলিক তন্ত্রে বিশ্বাসী দুই ভাইয়ের অত্যাচারে মহাকালগড়ের জনগণ অতিষ্ঠ ছিলেন। পরে শাহ্ মখদুম অত্যাচারী রাজার হাত থেকে মহাকালগড় তথা রাজশাহীর জনগণকে মুক্ত করতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শাহ্ মখদুম রূপোষ রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় ৪৪ বছর অবস্থান করেন। এ সময় ইসলাম ধর্ম প্রচারকালে দেওরাজদের সঙ্গে তাঁর তিনবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি ৭৩১ সালের ২৭ রজব) উপমহাদেশের অন্যতম সাধক রাজশাহীতেই মারা যান। এরপর তার কবরস্থানকে ঘিরে গড়ে উঠে মাজার।

নগরীর দরগাপাড়ায় অবস্থিত হযরত শাহ্ মখদুম রুপোষ (রহ.)-এর মাজার শরিফ থেকে কয়েক শ গজ পশ্চিমে গড়ে উঠে ঈদগাহ ময়দান। দরগা এস্টেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত ভাগের পর পরই রাজশাহীর তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুর আবদুল মজিদ সিএসপি, সাব ডেপুটি কালেক্টর আবদুল করিম চৌধুরী ও রাজশাহী জেলা পরিষদের প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে রাজশাহী নগরীর কেন্দ্রস্থল পদ্মার তীরঘেঁষে রাজশাহী হযরত শাহ্ মখদুম রুপোষ (রহ.) কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে এই ঈদগাহ ময়দানটি ৪ ফুট উঁচু প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এই প্রাচীর ক্রমেই ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়লে দরগাহ এস্টেট পরিচালনা কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সালাম ১৯৮৫ সালে পুরাতন এই প্রাচীরটি ভেঙে ফেলে সাত ফুট উঁচু একটি নতুন বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করেন।

১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর উদ্যোগে ঈদগাহ ময়দানের ভূমি উঁচু ও সমতল করা হয়। এরপর আধুনিক স্থাপত্যের পাঁচ ফুট উঁচু বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করা হয়, যা আজও বিদ্যমান। ইট, বালু, সিমেন্ট আর রড দিয়ে নান্দনিকভাবে তৈরি ঈদগাহ মাঠের এই বেষ্টনী প্রাচীরে অসংখ্য ছোট ছোট পিলার রয়েছে। ঈদগাহ ময়দানের চারদিকে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৬টি গেইট। ঈদগাহ ময়দানটির দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে আধুনিক কারুকার্যে নির্মিত হয়েছে ছোট্ট একটি মসজিদ। পাশেই রয়েছে ওজুখানা।

আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১৩ সালে তৎকালীন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন পদ্মা নদীর শহররক্ষা বাঁধকে সোজা করে এই ঈদগাহ মাঠকে দ্বিগুণ সম্প্রসারিত করেন। ওই বছরের ১০ সেপ্টেমম্বর তৎকালীন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এই সম্প্রসারণ কাজ উদ্বোধন করেন। মাঠে নতুন একটি মেহরাব তৈরী করা হয়। সেখানেই বর্তমানে ঈদের জামায়াত পড়ানো হয়।

শাহ্ মখদুম কেন্দ্রীয় এই ঈদগাহ ময়দানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের রাজশাহীর শীর্ষ নেতারা প্রতিবছর এক সঙ্গে ঈদের জামায়াতে শরিক হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা দুই ঈদের জামায়াতের আগে ও পরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ভুলে একে অপরের সঙ্গে কুশলবিনিময় ও কোলাকুলি করেন এই ঈদগাহ মাঠে এসে। প্রতিটি ঈদ শাহ মখদুম ঈদগাহ ময়দান যেন সম্প্রীতির মেলবন্ধনে পরিণত হয়। সামনে সিটি নির্বাচনকে ঘিরে রাজনিতক উত্তপ্ত পরিবেশের মধ্যেও এবার ঈদের জামাতে এমনটিই হবে বলে আশা করা যায়।

শাহ্ মখদুম দরগাহ এস্টেট কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৯২ সালের পূর্ব পর্যন্ত রাজশাহী কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানের রক্ষণাবেক্ষণ ও নামাজ ব্যবস্থাপনা দরগাহ প্রতিষ্ঠানের অর্থে পরিচালিত হতো। ১৯৯২ সাল থেকে ঈদগাহ মাঠে ঈদ ব্যবস্থাপনা, সামিয়ানা দ্বারা মাঠ সজ্জিতকরণ কাজসহ যাবতীয় কাজ সিটি করপোরেশন কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে আসছে। তবে সামগ্রিকভাবে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে পাঁচ সদস্যের এই এস্টেট কমিটি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও শাহ্ মখদুম দরগাহ এস্টেটের সদস্য ড. শরীফ উদ্দীন জানান, প্রতিবছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ঈদের জামায়াতের আগে মাঠ সুজজ্জিত, মাঠের প্রাচীর রং করার কাজ সিটি করপোরেশন থেকে করা হয়। এ ছাড়া কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হলেও তা করপোরেশন করে থাকে। রাজশাহীর কেন্দ্রীয় এই ঈদগাহ ময়দানকে আরও বেশি আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী এই এই ঈদগাহে তাবলীগ ইস্তেমা, ইস্তেগার নামাজ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকার যুবকরা এই মাঠে সকাল বিকাল খেলাধুলায়ও মেতে ওঠেন।

স/আর