হঠাৎ কেন এত বাংলাদেশি ওমরা পালনে?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাজধানীর মগবাজার এলাকার মাদকসেবী মুন (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় তিনি বলে ফেলেন, যার হাত ধরে মাদক জগতে এসেছেন তিনি, সেই আলী (ছদ্মনাম) সৌদি আরবে গেছে। মুনের ভাষ্যে, সেখানে ওমরা করার সেলফি তুলে আলী ফেসবুকের মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছে। শুধু তাই নয়, এও বলেছে, ‘দোস্ত দোয়া করিস, ওমরা করলাম। এখন থাইকা ভালো হইয়া গেছি।’

মুন জানান, নিজে মাদক নিতে নিতে আলী রাজধানীতেই বড় মাদক কারবারি হয়ে ওঠেন। সে যে কেমন ভালো হইছে আর কেন ওমরা করতে গেছে সবই বুঝি।

এমন ঘটনার কথা সম্প্রতি শোনা গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। রমজান শুরুর পর বড় সংখ্যক বাংলাদেশি সৌদি আরবে ওমরা হজ পালনে গেছেন, যেটিকে সংশ্লিষ্টরা অস্বাভাবিক বলছেন।

তাদের ভাষ্যে, ওমরা করতে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা অন্যান্য বছরে একই সময়ের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ হাজার বেশি। এরা সত্যিকার অর্থে ওমরাহ করতে গেছেন কিনা এ নিয়ে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা সন্দিহান।

বিভিন্ন হজ এজেন্সি, ইমিগ্রেশন পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাতে এমন তথ্য ও সন্দেহের কথা জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে, দুটি কারণে এ বছর ওমরা পালনে বেশি মানুষ বাংলাদেশ ছেড়েছেন। এক, হাতে প্রচুর টাকা আছে এবং তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। তারা চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের পরিণতি টের পেয়ে গা ঢাকা দিতে অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ওমরা করতে গেছেন।

দুই, সরকারবিরোধী শিবিরের বিত্তশালী নেতারাও অভিযানের সময়ে বিপদে পড়ার আশঙ্কায় ওমরার সুযোগ নিয়ে আপাতত দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

গত বছরের তুলনায় সুনির্দিষ্টভাবে কতজন বেশি মানুষ ওমরা পালনে গেছেন, তার সঠিক তথ্য দিতে পারেনি বিভিন্ন হজ এজেন্সি, হাব কিংবা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ। তবে তারা জানিয়েছে, এবার ১০ থেকে ১৫ হাজার অতিরিক্ত মানুষ ওমরা করতে গেছেন।

হাব জানায়, প্রতি রমজানে বাংলাদেশ থেকে লক্ষাধিক মানুষ ওমরা পালনে যান। তিন দিন, ১০ দিন থেকে শুরু করে কেউ কেউ পুরো রমজান মাস পবিত্র মক্কা শরিফে এবাদত-বন্দেগি করে সময় কাটান।

এ বিষয়ে কারওয়ানবাজারের ট্রাভেলিং অ্যান্ড টিকেটিং এজেন্ট এসএস ট্রাভেলসের স্বত্ত্বাধিকারি নিতাই চন্দ্র বলেন, ‘কি পরিমাণ মানুষ এবার ওমরা করতে গেছেন, আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে এটা বলতে পারি এ বছর অন্যবারের তুলনায় অন্তত ১০ হাজার বেশি মানুষ ওমরা করতে গেছেন।’

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল শুক্রবার রাতে বলেন, ‘বিষয়টি আমার চোখেও পড়েছে। বিগত কয়েকদিন ধরেই দেখছি হঠাৎ বিভিন্নজন মাথায় টুপি দিয়ে হাজির হচ্ছেন। সালাম দিয়ে বলছেন, ওমরা পালন করে এসেছি, দোয়া করবেন। এদের আগে কখনো সেভাবে ধর্মীয় বিষয়ে সচেতন দেখিনি। আমার কাছেও বিষয়টি খটকা লেগেছে।’

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে যান, তাকে তো বাধা দেয়া যায় না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরাও খোঁজ-খবর নেব।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘ওমরা পালনের নামে আমাদের দেশের কতিপয় মানুষের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে পাড়ি জমান। এজন্য এ বিষয়ে সরকার নজরদারি করছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিবর্তন ডটকমকে জানান, এবার ওমরা পালনকারীদের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতার জন্য তাদের ওপর নির্দেশনা রয়েছে।

তবে তিনি এও জানান, অপরাধীদের তালিকা তাদের কাছে আছে, এমন কাউকে পেলে বিমানবন্দরেই আটকে দেয়া হয়।

তালিকা থেকে থাকলে অপরাধীরা বিদেশ যাচ্ছেন কিভাবে— এমন প্রশ্নের জবাবে ইমিগ্রেশন পুলিশের এই কর্তা জানান, তাদের কাছে শুধুমাত্র বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার তালিকা রয়েছে। এরপরও অনেক সময় দাগী আসামিরা ইমিগ্রেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যান।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের সরাসরি বিদেশে গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা বা তালিকা ইমিগ্রেশন পুলিশকে দেয়া হয়নি।’

হজ এজেন্সিস অব বাংলাদেশের (হাব) নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শাহদাত হোসেন জানান, ওমরা পালনের সঠিক হিসাব তাদের কাছে থাকে না। তারা শুধু হজ পালনে ইচ্ছুকদের হিসাব বলতে পারেন।

তবে তিনি বলেন, ‘এবার বেশি বেশি মানুষ ওমরা করতে যাচ্ছেন বলে শুনেছি। তবে তারা কোনো অভিযানের ভয়ে যাচ্ছেন কিনা তা অনুমানের ভিত্তিতে বলা মুশকিল।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওমরা ভিসা নিয়ে যারা সৌদি আরব গেছেন, তাদের মধ্যে অপরাধীরা সেখান থেকে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কারণ, ওমরা ভিসার মেয়াদ শেষে দেশটিতে বেশিদিন অবস্থান করা সম্ভব নয়।

সৌদি আরবে ওমরা পালনে এসে কেউ বাড়তি সময় থাকলে এবং ধরা পরলে ৫০ হাজার রিয়েল জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, দেশ ছাড়ার জন্য ওমরা ভিসাকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করেন অনেকে। ধর্মীয় কারণে সবখানে শিথিলতা পান। কিন্তু, তারা আগেই পাসপোর্টে অন্য দেশের ভিসা সংগ্রহ করে রাখেন। ওমরা পালনের নাম করে দেশ ছাড়েন। পরে সেখান থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাড়ি জমান।

রাজনৈতিক প্রতিকূলতার অজুহাত দেখিয়ে এবার বড় সংখ্যক বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা ওমরা পালন করতে গেছেন বলে দল সূত্রে জানা গেছে। মাদকবিরোধী অভিযানের শিকার হতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকেও দলটির সামর্থবান অনেকে ওমরা করতে গেছেন।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকারি দলের মামলা-হামলার মুখে আমাদের নেতাকর্মীরা নিজ বাড়িতে বা এলাকায় থাকতে পারেন না। তাই তারা যেখানে নিরাপদ মনে করেন, সেখানেই অবস্থান নেন। দল থেকেও এ ধরনের অনুমতি দেয়া আছে।’

চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে নেতাকর্মীরা নিজ এলাকায় পবিত্র ঈদুল ফিরত পালনে ভীতির মধ্যে আছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

হঠাৎ ওমরা করার প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়ে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এমন একটি কৌতূহল আমিও জেনেছি। আসলে মাদকবিরোধী অভিযানের পর কক্সবাজারের আলোচিত আওয়ামী লীগের এমপি আব্দুর রহমান বদির ওমরা পালনে যাওয়া নিয়েই মনে হয় এটি সামনে আসছে। তবে অপরাধীরা ওমরা পালনের নামে যাতে কোথাও পালিয়ে থাকতে না পারে, সেটি সরকারের দেখা উচিত।’