৯৫ কোটি টাকার প্রাণি সম্পদ প্রকল্পে নয়ছয়

ভোলাসহ ৭ জেলার ১৬ উপজেলায় ৯৫ কোটি টাকার উপকূলীয় চরাঞ্চলের সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পের অধীন সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী করতে জনপ্রতি একটি ঘর, ২০টি করে হাঁস ও মুরগির বাচ্চা দেয়া হলেও এক মাসের মধ্যে বেশির ভাগ বাচ্চা মারা গেছে। ৮ হাজার টাকা মূল্যের ঘরের পরিবর্তে দেয়া হয়েছে দুই হাজার টাকা ব্যয়ে তৈরি নিম্নমানের ঘর, যা চরের নারীরা বাড়ি নিতে নিতেই ভেঙে গেছে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে। মঙ্গল ও বুধবার প্রকল্পের পরিচালক ডা. নিতাই চন্দ্র দাস ভোলার দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলায় কর্মকাণ্ড পরিদর্শনে গেলে সুবিধাভোগীদের তোপের মুখে পড়েন।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প পরিচালক নামে-বেনামে ও আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে উপকরণ বিরতণ করে চলেছেন। ঘর সরবরাহের টেন্ডার পায় ঢাকার এমএম মল্লিক অ্যান্ড কোম্পানি। ওই প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার মাহাবুব আলম মল্লিক বুধবার জানান, জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত টেন্ডারে প্রতি ঘর ৮ হাজার টাকা দরের মধ্যে তিনি ৭ হাজার ৩৩৯ টাকা দরে টেন্ডারে অংশ নেন। গত মাস থেকে তিনি সরবরাহ শুরু করেছেন। কিন্তু তার কার্যাদেশ পাওয়ার আগে এক উপজেলায় ২৩৭৫টি ঘর বিতরণ করা হয়। নিম্নমানের ওই ঘর বিতরণের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। এর দায়ভার তিনি নিতে পারেন না বলেও জানান। হাঁস ও মুরগির বাচ্চাসহ খাবার সরবরাহ টেন্ডারের ঠিকাদার প্রকল্প পরিচালক নিজেই বলে অভিযোগ করেন মাহবুব আলম।

প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বরিশাল বিভাগের ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার জেলার ১৬ উপজেলায় এ প্রকল্পের অধীন চরাঞ্চল এলাকার ইউনিয়নের ৯০ ভাগ নারী ও ১০ ভাগ পুরুষকে সুবিধাভোগী হিসেবে তালিকা করা হয়। এক উপজেলায় সুবিধাভোগীদের মধ্যে ১৫শ’ জন পাবেন জনপ্রতি ৩টি করে ভেড়া, একটি ঘর, ৫০ কেজি খাবার। ২ হাজার ২৫০ জন পাবেন একটি করে ঘরসহ ২০টি মুরগির বাচ্চা, ১৪৩ কেজি খাবার ও ওষুধপত্র। ৩ হাজার ৭৫০ জন পান একটি ঘরসহ ২০টি হাঁসের বাচ্চা, ১৪৩ কেজি খাবার ও ওষুধ। প্রকল্পের তিন বছরের মধ্যে ইতোমধ্যে দুই বছর শেষ হয়। উপজেলা পর্যায়ে ৭ হাজার ৫শ’ জনের মধ্যে অর্ধেক সুবিধাভোগীকে এ উপকরণ দেয়া হয়। ২০২০-২০২১ সালের মধ্যে অন্যরা একই হারে সুবিধা পাবেন বলে জানান জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ কুমার মণ্ডল।

দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মাইক্রোচালক সোলায়মান জানান, তার স্ত্রী সাহেরা খাতুন দেড় মাস আগে ২০টি হাঁসের বাচ্চা পেয়েছেন। এখন একটি বাচ্চা জীবিত রয়েছে। ভবানীপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের বশিরের স্ত্রী হালেমা বেগম, নসুর স্ত্রী ময়ফুল, শাজাহান মাঝির স্ত্রী মমতাজ বেগম, ১নং ওয়ার্ডের সফিজুলের মেয়ে নাসিমা বেগম, ৩নং ওয়ার্ডের কবিরের স্ত্রী ফরিদা বেগম জানান, তাদের বেশির ভাগ বাচ্চা মারা গেছে। ঘরবাড়ি নিতে নিতে ভেঙে যায়।

চরফ্যাশন উপজেলার কুকরীমুকরী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান প্রেস ক্লাব সভাপতি হাসেম মহাজন জানান, ওই উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন এ প্রকল্পের অধীন রয়েছে। এখানে নিম্নমানের সব উপকরণ বিতরণ করা হয়। ভানীপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম নবী নবু জানান, এটি একটি লুটপাটের প্রকল্প হয়েছে। গ্রামের মানুষের কোনো উপকারে আসছে না। ৩০০ টাকা দরে ২ মাস বয়সী বাচ্চা দেয়ার কথা থাকলে তা দেয়া হয়নি। যে বাচ্চা দেয়া হয়, এর দাম সর্বোচ্চ ৪০ টাকা হতে পারে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানান, তারা কেবল সুবিধাভোগীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। ভোলা জেলায় ২৫ জন করে ১৩৬টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এজন্য বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আরও ৪ হাজার একশ’ জন প্রশিক্ষণ পাবেন আগামী এক বছরে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ জেলার চিত্রই এটি।

তবে পটুয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আনোয়ার হোসেন জানান, তার জেলায় আগে ঘর দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এতে তারা রাজি হননি। বর্তমানে তার এলাকায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে ঘর তৈরি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ভোলায় দুইদিনের সফরে এসে দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলা পরিদর্শন করে প্রকল্প পরিচালক ডা. নিতাই চন্দ্র দাস বুধবার বিকালে বরিশাল হয়ে ফিরে যান। দুপুর ২টা থেকে ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত কয়েকবার তার মোবাইল ফোন নম্বরে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

ভোলাসহ দুই বিভাগের সাত জেলায় উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি)  জানান, ভোলায় তিন শতাধিক নিম্নমানের ঘর বিতরণ করা হয়েছে। বেশ কিছু হাঁস-মুরগির বাচ্চা মারা গেছে এমন অভিযোগ পেয়ে তিনি সরেজমিন দেখতে আসেন। কিন্তু দৌলতখান সফরকালে তাকে নাজেহালের চেষ্টা করা হয়। তিনি জানান, এমনটা তিনি কখনই আশা করেননি। মুরগি ও হাঁসের বাচ্চা দেয়ার ১৪ দিনের মধ্যে মারা গেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেনটেক ক্ষতিপূরণ দেবে। নিম্নমানের ঘর যারা দিয়েছে তাদের বিল দেয়া হবে না। তিনি যুগান্তরকে জানান, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা প্রকল্পের জেলা কমিটির সভাপতি। টেন্ডার সিডিউল অনুযায়ী এসব মালামাল বা উপকরণ ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেয়ার দায়িত্বে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার। আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে টাকার বিনিময়ে নিম্নমানের ঘর বুঝে রাখা হয়েছে। এ কারণে তড়িঘড়ি করে ওইসব ঘর বিতরণ করা হয়। সব ঘর (শেড) সরবরাহ করে এমএম মল্লিক অ্যান্ড কোম্পানি। ঘরের জন্য ১৩ কোটি টাকার বিলের চেক তিনিই গ্রহণ করেন। নিম্নমানের ঘর দেয়ার জন্য ঠিকাদার দায়ী হবেন। একেক জেলায় সুফলভোগী পরিবারের সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, এই প্রকল্পের প্রশিক্ষণ ছাড়া আর কোনো বিষয় তারা জানেন না। টেন্ডার সিডিউল কপিও তাদের কাছে নেই।

ভোলার দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিতেন্দ্র নাথ জানান, প্রকল্প পরিচালক দৌলতখান সফরকালে তোপের মুখে পড়েছেন। কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান তার কাছে তথ্য জানতে চান। এ সময় স্থানীয় সাংবাদিকরাও ছিলেন বলে শুনেছেন।

 

সুত্রঃ যুগান্তর