হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মৃত্যু

সিলেটে কারও কথাই যেন শুনছে না বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো। রোগী ও স্বজনদের আকুতি তাদের মন গলাতে পারছে না। ফলে একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে বিনা চিকিৎসায় প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে। এক সপ্তাহে সিলেটে বিনা চিকিৎসায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার সিলেটের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করেছেন।

মারা যাওয়া ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন খোকা (৫৫) নগরীর কুমারপাড়ার বাসিন্দা। বন্দরবাজারে আর এল ইলেকট্রনিক্স নামে তার একটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

ইকবাল হোসেন খোকার ছেলে তিহাম জানান, শুক্রবার ভোরে তার বাবার বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন তারা নগরের সোবহানীঘাটের আল হারামাইন হাসপাতালে যোগাযোগ করে দ্রুত একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে অনুরোধ করেন। অ্যাম্বুলেন্স বাসায় যাওয়ার পর দেখা যায়, এতে অক্সিজেন সিলিন্ডার বসানো থাকলেও তা কাজ করছে না। এরপরও ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে ইকবাল হোসেনকে আল হারামাইন হাসপাতালে নেয়া হয়।

তিনি জানান, সেখানে নেয়ার পর হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা রোগীকে জরুরি সেবা দেওয়ার পরিবর্তে নানা নিয়ম-কানুন অনুসরণ, করোনা কি-না, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। রোগীর স্বজনরা অন্তত জরুরি ভিত্তিতে রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার অনুরোধ করলেও তারা সাড়া দেননি। এক পর্যায়ে তারা রোগীকে ভর্তি করবেন না জানিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে বলেন।

তিহাম জানান, এরপর ইকবাল হোসেনকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেটের বেসরকারি নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে যাওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তাদের হাসপাতালে আইসিইউ সিট খালি নেই। চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়।

তিহাম জানান, তার বাবার সঙ্কটাপন্ন অবস্থা দেখে দ্রুত তারা তাকে সিলেটে করোনা চিকিৎসাকেন্দ্র শহিদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষার পরও সংশ্লিষ্ট কেউ এগিয়ে আসেননি। একপর্যায়ে হাসপাতালের একজন নিরাপত্তাকর্মী তাদের জানান, হাসপাতালের সবাই ঘুমে। রোগীকে অন্যত্র নিয়ে যেতে বলেন।

এরপর ইকবাল হোসেনকে নেওয়া হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে জরুরি বিভাগের বারান্দায় একটি পরীক্ষা করে হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান রোগী মারা গেছেন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিহাম বলেন, ‘একের পর এক হাসপাতাল ঘুরেও বাবার চিকিৎসা তো দূরে থাক, একটু অক্সিজেনও জোগাড় করতে পারিনি। অনেক অনুরোধ করলেও তারা সাড়া দেননি। তিহাম বলেন, আর কোনো বাবার যেন এমন পরিণতি না হয়।’

এ ব্যাপারে আল হারামাইন হাসপাতালের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে হাসপাতালের ইনচার্জ এম ইউ শাওন বলেন, ‘ওই সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। যিনি দায়িত্বে ছিলেন তার নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।’

নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করলে একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাদের হাসপাতালের একটি বড় ইউনিট করোনা চিকিৎসার জন্য আলাদা করা হয়েছে। অন্য অংশে আইসিইউ কেবিন খুব বেশি নেই। কেবিন খালি না থাকায় তারা রোগী ভর্তি করতে পারেননি।

ওই কর্মকর্তা আরো জানান, তারা সব ধরণের রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আইসিইউ প্রয়োজন এমন রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে কেবিন খালি না থাকলে তাদের কিছুই করার থাকে না।

শহিদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুশান্ত কুমার মহাপাত্র জানান, ‘তিনি হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছেন ভোর ৫টা ৪৭ মিনিটে একটি অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের গেইটে এসেছিল। দুই মিনিট পরই অ্যাম্বুলেন্সটি চলে যায়। অ্যাম্বুলেন্সের কেউ হাসপাতালের কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।

মারা যাওয়া ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেনের ছেলের অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, হাসপাতালের সবাই ঘুমিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই। কী ঘটেছিল তা সিসিটিভি রেকর্ডেই আছে।

এর আগে রবিবার সিলেট নগরীর কাজিরবাজারের মোগলটুলার লেচু মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৬০) নগরের ৬টি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও বিনা চিকিৎসায় মারা যান। মনোয়ারা বেগম অ্যাজমা রোগী ছিলেন। পরদিন সোমবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে আসা আরেক বৃদ্ধা নারী সিলেট নগরীর একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা পাননি। পরে অ্যাম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়।

বিনা চিকিৎসায় এসব মৃত্যুর ঘটনায় সিলেটে তোলপাড় শুরু হয় সরকারি-বেসরকারি মহলে। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় থেকে নগরীর সব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে কভিড ও নন-কভিড সব রোগী ভর্তি ও যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়।

কিন্তু চিঠি পাঠানোর পরদিনও ঘটেছে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. সুলতানা রাজিয়া বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, কোন রোগী তারা ফেরত পাঠাতে পারবে না। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও অমানবিক-অনাকাক্সিখত ঘটনা ঘটছে।’

এ ব্যাপারে সিলেট প্রাইভেট হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. নাসিম হোসেন জানান, কোভিড ও নন কোভিড সব ধরণের রোগী ভর্তির ব্যাপারে তারা সরকারি নির্দেশনা পেয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু জটিলতা রয়েছে। করোনা সন্দেহভাজন রোগী ভর্তি করার ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে তারা দফায় দফায় বৈঠকও করছেন।

সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব হাসপাতাল-ক্লিনিক সরকারের নির্দেশনা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।’ সূত্র: ;দেশ রুপান্ত