হঠাৎ এই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার কারণ কী?

একটা গল্প দিয়ে আজকের লেখাটা শুরু করি। ১৯৫৩ সালের কথা। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসন চলছে। কেন্দ্রে খাজা নাজিমউদ্দীনের রাজনৈতিক সরকারকে অপসারণ করে সামরিক জান্তার তাঁবেদার বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে এনে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসানো হয়েছে।

এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন চলছে। হক সাহেব, মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর শক্তিশালী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অভিমত জানান, এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় সুনিশ্চিত।

এই পরাজয় গোপন চক্রান্ত দ্বারা কীভাবে ঠেকানো যায় অথবা মুসলিম লীগ পরাজিত হলে সম্ভাব্য যুক্তফ্রন্ট সরকারকে কীভাবে ক্ষমতায় বসতে না বসতেই বরখাস্ত করা যায়, তা নিয়ে ঢাকার বর্ধমান হাউসে (তখন ছিল মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন, এখন বাংলা একাডেমি) এক গোপন বৈঠক বসে।

এ বৈঠকে হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন, প্রাদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান, চিফ সেক্রেটারি মোহাম্মদ ইসহাক, মর্নিং নিউজ সম্পাদক সৈয়দ মহসিন আলী এবং আজাদের মুজিবর রহমান খাঁসহ আরও উচ্চপর্যায়ের দু’একজন ব্যক্তি।

সভায় আলোচনা হয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় এড়ানো যাবে না। যেটা পারা যাবে, তা হল ক্ষমতায় বসার পর যুক্তফ্রন্ট সরকারের কোনো একটি খুঁত ধরে তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন চৌধুরী খালিকুজ্জামান। তিনি হক সাহেবের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। তাকে কাজে লাগানো যাবে না বুঝতে পেরে গভর্নর পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্তও এ গোপন বৈঠকে হয়।

সভায় বগুড়ার মোহাম্মদ আলী জানান, হক সাহেবের স্লিপ অব টাঙের অভ্যাস আছে। এখন বয়স হওয়ায় তার এ অভ্যাস আরও বেড়েছে। সুতরাং সুযোগ খুঁজতে হবে হক সাহেবের এ ধরনের কোনো স্লিপ অব টাঙের জন্য। হক সাহেবকে যে অতীতে মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহ দল থেকে বহিষ্কারের সময় ট্রেইটর বলেছিলেন এবং অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইংরেজ গভর্নর স্যারজন হার্বার্ট তাকে বরখাস্ত করেছিলেন, তা খুঁজে বের করার জন্য মর্নিং নিউজ সম্পাদককে দায়িত্ব দেয়া হয়।

এই সভায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তিনি আমেরিকা থেকে কালাহান নামে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক যাতে নির্বাচনকালে ঢাকায় উপস্থিত থাকেন, তার ব্যবস্থা করার জন্য বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে অনুরোধ জানান।

এ বৈঠকে হাজির ছিলেন ঢাকা থেকে তখন প্রকাশিত ইংরেজি সান্ধ্য দৈনিক ‘ডেইলি মেইলের’ সম্পাদক আজিজ আহমদ। তিনি বিহার থেকে ঢাকায় এসে মোহাজের হয়েছিলেন। সাংবাদিক মহল তাকে পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের চর মনে করতেন। ১৯৭১ সালে ঢাকা থেকে করাচিতে পলায়নের আগে তিনি ডেইলি মেইল পত্রিকায় যে ডায়েরি লেখেন, তাতে ১৯৫৩ সালের এ গোপন বৈঠকের কথা উল্লেখ করে যান।

কালাহান ছিলেন মার্কিন সাংবাদিকের লেবেল লাগানো সিআইএ’র গুপ্তচর। সিআইএ যেসব দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছে সেসব দেশে কালাহান ও তার বন্ধু সাংবাদিকদের ব্যবহার করা হতো। ১৯৫৩ সালে কালাহান যখন মার্কিন সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় আসেন, তখন রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়। সাদা রঙের সাহেব সাংবাদিক! উচ্চ সরকারি মহলে তার খাতির তোয়াজের অন্ত ছিল না। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল জয়লাভের পর হক সাহেব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন। কালাহান তার সঙ্গে লেগেই ছিলেন।

এক সময় যুক্তফ্রন্টকে আঘাত হানার সুবর্ণ মুহূর্ত এলো, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য বৈরুতে চলে যান। মওলানা ভাসানী যান ইউরোপে। ঢাকায় হক সাহেব একা। তার হাঁটুতে পুরনো বাতের ব্যথায় চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেলেন।

যে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে একটানা দু’বছর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সারা অবিভক্ত বাংলার শাসন চালিয়েছেন, সেই ভবনে ঢুকে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন এবং সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন, ‘আমি কোনো দেশের রাজনৈতিক বিভাগকে গুরুত্ব দেয়নি। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি অভিন্ন’ (কলকাতার যুগান্তরে প্রকাশিত হক সাহেবের ভাষণ থেকে)।

কালাহান এ ভাষণকে বিকৃত করে ঢাকায় খবর পাঠালেন, হক সাহেব কলকাতায় বলেছেন, ‘আমি দেশের রাজনৈতিক বিভাগকে মানি না।’ কালাহানের এ রিপোর্ট ঢাকায় আজাদ ও মর্নিং নিউজ বিরাটভাবে ছাপল। ফজলুল হক পাকিস্তান সৃষ্টি মানেন না। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ আবার যুক্ত করতে চান ইত্যাদি অভিযোগ তোলা হল।

হক সাহেব যতই বলেন, তিনি এ ধরনের কথা বলেননি, ততই কালাহানের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে হক সাহেবকে মিথ্যাবাদী সাজানো হল। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে জিন্নাকে উদ্ধৃত করে ফজলুল হককে ‘ট্রেইটর’ বলে গালি দিলেন।

আদমজী নগরে বিহারিদের উসকে দিয়ে বিহারি-বাঙালি ভয়াবহ দাঙ্গা বাধানো হল। হক মন্ত্রিসভা এ দাঙ্গা থামিয়েও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেন না। কালাহানের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণায় হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে হক সাহেবকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল।

বহুকাল আগের এ গল্পটা বললাম এজন্য যে, চক্রান্তের রাজনীতিতে সাহেব সাংবাদিক ও সাহেব রাষ্ট্রদূতদের জড়ানোর অথবা তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার অভ্যাস আমরা যে ছাড়তে পারিনি, তা দেখানোর জন্য। অতীতের ‘আজাদ’, ‘মর্নিং নিউজের’ সাংবাদিকতার একদল অনুচর ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিক’ সেজে এ কাজটা করেছেন।

তার একটা সাম্প্রতিক প্রমাণ পেলাম একটি জাতীয় দৈনিকে। মার্কিন সাংবাদিক কালাহানের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্টকে মূলধন করে এক সময় পাকিস্তানের রাজনীতিকে বিষাক্ত করা এবং রাজনীতিকদের নিন্দিত করার জন্য একটি স্বৈরাচারী মহল যে প্রচারণা চালিয়েছিল, নতুন করে সেই চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছি দৈনিকটির এক কবি ও সাংবাদিকের লেখায়।

নিবন্ধটির শিরোনাম ‘বিউটেনিসের মন্তব্যকে নেতা-নেত্রীরা কীভাবে নেবেন?’ এ বিউটেনিস কে? বিউটেনিস ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত সরকারের শেষ সময় থেকে সেনা তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরম্ভের কয়েক মাস ছিল তার ঢাকার কার্যকাল। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের জনগণের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু রাজনীতিবিদদের প্রশংসা করতে পারেননি। তার মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাজ-কাম ছিল তার জন্য বিব্রতকর।

সবাই তাদের রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলতে চাইত। বিউটেনিস দীর্ঘকাল আগে বাংলাদেশের রাজনীতির এক গভীর সংকটের সময় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। এত দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ‘সতীত্বপনার’ দাবি তিনি কেন করলেন এবং দৈনিকটির ‘কবি ও সাংবাদিকই’ বা কেন বাংলাদেশের রাজনীতিকদের চরিত্র হননকারী এ লেখা নিয়ে আলোচনা করার তাগিদ অনুভব করলেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

পঞ্চাশের দশক থেকে আমেরিকার নীতি হচ্ছে সদ্যস্বাধীন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকদের ব্যর্থ ও দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অনুগত সামরিক অথবা স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে তাদের স্বার্থ ও আধিপত্য রক্ষা করা।

এখন বিউটেনিস দাবি করছেন বাংলাদেশের রাজনীতিকরা তাকে রাজনীতিতে টানার চেষ্টা করেছে। দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের চরিত্রহননের দায়িত্ব পালন করছে জন্ম থেকে দৈনিকটি। তাই বিউটেনিসের কথা তাদের কানেও মধুবর্ষণ করেছে এবং দেশের রাজনীতিকদের এক হাত নেয়ার এ সুযোগটি দৈনিকটি হাতছাড়া করেনি।

নইলে তারাও জানেন, বাংলাদেশে আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে কোনো রাষ্ট্রদূত দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শুধু হস্তক্ষেপ করা নয়, সরকার পরিবর্তনেও জড়িত হননি? বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের ডেকে আনতে হয়নি। তারা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে জড়িত হয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, কঙ্গো, চিলি, পাকিস্তান, তুরস্ক ইত্যাদি কোনো দেশের রাজনীতিতে তারা নাক গলাননি এবং রক্তাক্ত কাণ্ড ঘটাননি? কঙ্গোর লুমুম্প, চিলির আলেন্দে, বাংলাদেশের শেখ মুজিবসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক নেতার হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাদের হাত ছিল?

বিউটেনিস এখন সতীপনার দাবি করছেন এবং তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছে দৈনিক পত্রিকাটি। যে পত্রিকা দেশে শেখ হাসিনা যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারেন, সেজন্য ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারিয়া ও কতিপয় ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনকে প্রভাবিত করে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল।

অসত্য প্রচারে দৈনিকটির জুড়ি নেই। তাদের কবি ও সাংবাদিক লিখেছেন, ‘৭ জানুয়ারির তার বার্তায় বিউটেনিস লিখেছেন, তিনি ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা তাকে জানান যে, আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রথম সারির নেতা তাদের কাছে এসেছিলেন এমন রাজনৈতিক সুপারিশ নিয়ে যার মধ্যে আছে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ।’ বিউটেনিসের এ তার বার্তায় আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগের ওই নেতারা সামরিক হস্তক্ষেপ দ্বারা সমস্যার সমাধানের কথা বললে তিনি তাদের জানান, তার দেশ সেনাবাহিনীর সংবিধানবহির্ভূত ভূমিকার বিরোধী।

আমেরিকা সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব চায় না। বিউটেনিসের এ মন্তব্য পাঠ করে মনে হল, কেউ বলছেন, শিয়াল মুরগি শিকার করে না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে (বাংলাদেশসহ) সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় কলকাঠি নেড়ে এখন বলা হচ্ছে আমেরিকা সামরিক অভ্যুত্থান চায় না।

বিউটেনিসের আগের এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার বাংলাদেশে মুজিব হত্যা ও সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় কী ভূমিকা নিয়েছিলেন, এ কূটনীতিক কি সে ইতিহাস জানেন না? বলা হয়েছে মাইনাস টু’র প্রস্তাব নিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা মার্কিন ও ব্রিটিশ দূতের কাছে গিয়েছিলেন। আরেকটি ধাপ্পাবাজি!

এখন সবাই জানেন মাইনাস টু’র থিয়োরির আবিষ্কর্তা সুশীল সমাজের নেতা ড. কামাল হোসেন। সুশীল সমাজ ও দুটি দৈনিক তাতে জোর সমর্থন দিয়েছিল। তারা আওয়ামী লীগের ও বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে নানা ধরনের ভয় দেখিয়ে এই থিয়োরিকে সমর্থন দানে বাধ্য করেছিলেন। সমর্থন আদায়ের পর দুই নেত্রীর কাছেই তাদের এক্সপোজ করা হয় এবং তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার প্রায় ধ্বংস করা হয়।

তখনকার সেনা তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই মাইনাস টু থিয়োরি কার্যকর করতে পারবেন বলে সুশীল সমাজ ও দৈনিক দুটি বুক বেঁধে আশা পোষণ করছিল। কিন্তু তাদের সব চক্রান্তই ব্যর্থ হয়।

এখন দীর্ঘকাল পর বিউটেনিসকে সামনে খাড়া করে সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে দৈনিকটি গায়ের ময়লা দূর করতে চায় কি? চাইলেই কি পাওয়া যায়! এ যুগের পাঠকসমাজ খুবই সচেতন। তাদের চোখে ধুলো দেয়া এখন আর সম্ভব নয়।

লন্ডন, ২৬ ডিসেম্বর, শনিবার ২০২০

 

সুত্রঃ যুগান্তর