স্বাস্থ্যবিধি ভুলে হাটবাজার মার্কেটে মানুষের ভিড়

করোনাভাইরাসের প্রকোপ রোধে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউনের খবরে স্বাস্থ্যবিধি ভুলে কেনাকাটায় মেতেছে মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাটবাজার ও মার্কেটে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। ‘লকডাউনের’ মধ্যে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে শুক্রবার থেকে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সাপেক্ষে দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব তেমন একটা মানা হয়নি।

গাদাগাদি-ঠেলাঠেলি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ অনেকেই সেরে ফেলছেন ঈদের কেনাকাটা। এদিকে ফের লকডাউনের খবরে ঢাকা ছাড়ছেন অনেকে। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় ছোট গাড়িতে ভেঙে ভেঙে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও শিমুলিয়া ঘাটে ভিড় করেন তারা। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চট্টগ্রাম : মার্কেট ও শপিংমল খোলার তৃতীয় দিন রোববার কিছু কিছু মার্কেট ও শপিং সেন্টারে উপচে পড়া ভিড় ছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রামের টেরিবাজার, রিয়াজুদ্দিন বাজার, তামাকুমুন্ডি লেন ও জহুর হকার্স মার্কেটে ভিড় ছিল লক্ষণীয়। শিশুদের নিয়েও নারীরা কেনাকাটা করতে মার্কেটে ভিড় করেন। এসব মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই ছিল না। অনেককে মাস্ক না-পরেই কেনাকাটা করতে দেখা গেছে। যদিও অভিজাত শপিংমলগুলোয় কঠোর স্বাস্থ্যবিধি পালন করা হয়েছে। তবে সেখানে তেমন ক্রেতা দেখা যায়নি।

টেরিবাজার এলাকার বাসিন্দা দ্বৈপায়ন পাল নামে তরুণ সংস্কৃতিকর্মী যুগান্তরকে বলেন, পোশাকের দোকানে কেনাকাটার এমন দৃশ্য সত্যি অবিশ্বাস্য। করোনার এমন প্রকোপের মধ্যে যেখানে সরকারের তরফ থেকে সচেতন করা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অথচ এসবের তোয়াক্কা করছে না কেউই। সাধারণ মানুষ যদি সচেতন না-হয় লকডাউন বা নির্দেশনা দিয়ে কী হবে।

টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি ফরিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সোমবার টেরিবাজারে ক্রেতা কিছুটা বেড়েছে। তবে তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। চারদিন পর দোকান খুলতে পেরে ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও ফের লকডাউনের খবরে হতাশ। ব্যাংক ঋণ, ধারদেনা করে দোকানে পুঁজি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ভরা মৌসুমে লকডাউন আমাদের পথে বসাবে।

বরিশাল : নগরীর চকবাজার, পদ্মাবতী ও কাঠপট্টি বিপণিবিতানগুলোয় গাদাগাদি করে কেনাকাটা করছেন সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ ক্রেতা মাস্ক পরলেও সামাজিক দূরত্ব মানছেন না। এ ছাড়াও সদর রোড, গির্জামহল্লা, লঞ্চঘাট ও বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাতে ভিড় বেড়েছে। এসব এলাকার অস্থায়ী দোকানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না-করেই চলছে কেনাকাটা। নগরীর কাশিপুর থেকে আসা ক্রেতা ফরিদা বেগম জানান, ঈদের কেনাকাটা করতে চকবাজারে এসেছেন। সামনে লকডাউন তাই এখনই ঈদের কেনাকাটা করতে বের হয়েছেন বলে জানান তিনি।

আরেক ক্রেতা বলেন, সামনে কঠোর লকডাউন। তাই রমজানের খাদ্যসামগ্রী কিনতে ঝুঁকি নিয়ে বাজারে এসেছেন। চকবাজারের বিপণিবিতানের বিক্রেতা মাহমুদ হাসান বলেন, গত ঈদেও আমরা ব্যবসা করতে পারিনি। এ বছরও মনে হয় সেই একই পরিমাণ ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি কোনোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে দাবি তার।

বরিশাল জনস্বার্থ রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব মানুওয়ারুল ইসলাম অলি বলেন, মানুষ ঈদের বাজার করতে শুরু করেছে। অনেক খাবারসহ বিভিন্ন মালামাল রিজার্ভ করছে। বরিশাল জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুব্রত কুমার বিশ্বাস বলেন, আমরা মানুষকে নানাভাবে সচেতন করেছি। এখন জরিমানা করা হচ্ছে। প্রতিদিনই অভিযান চলছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এদিকে লকডাউন চলাকালে শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও খাদ্য রেশনিং চালুর দাবিতে বরিশালে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় নগরীর সদর রোডে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখার উদ্যোগে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের আহ্বায়ক ইমরান হাবীব রুমনের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন বাসদ জেলা শাখার সদস্যসচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী, শ্রমিক নেতা মানিক হাওলাদার, মিতা বেপারি, শহিদুল ইসলাম প্রমুখ।

রাজশাহী : মহানগরীর সাহেববাজার, কোর্টবাজার, নিউমার্কেট, আরডিএ মার্কেট, গণকপাড়া এবং লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি বাজারে ক্রেতার ভিড় দেখা গেছে। কঠোর লকডাউনের মধ্যে সামনে রমজানে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে-এমন আশঙ্কায় কেনাকাটা সারছেন অনেকে।

আরডিএ মার্কেটে ক্রেতা সমাগম ছিল সবচেয়ে বেশি। ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনার মতোই এ মার্কেটে মানুষের ভিড় ছিল। মহানগরীর অন্যান্য জায়গায় যানবাহন চলাচল কিছুটা কম থাকলেও সাহেববাজার এলাকায় যানজট দেখা গেছে। যানচলাচল স্বাভাবিক রাখতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা ব্যস্ত ছিলেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, লকডাউনের কারণে কয়েকদিন তেমন কোনো ক্রেতা ছিল না। কিন্তু সামনে কড়া লকডাউনের খবরে ক্রেতা বেড়েছে। তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন সরকারি নির্দেশনানুযায়ী মাস্কসহ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত হচ্ছে না।

সিলেট : নগরের বেশিরভাগ মার্কেট ও বিপণিবিতানে বিক্রেতারা অলস সময় পার করছেন। কোনো কোনো দোকানে কয়েকজন ক্রেতার দেখা পাওয়া গেলেও বেচাকেনা নেই বললেই চলে। বিকাল থেকেই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের ভিড় বাড়ে নগরীর বিভিন্ন সড়কে। এ সময় ক্রেতাদের ভিড়ও বাড়ে। তবে সেই ভিড়ে কোথাও থাকে না স্বাস্থ্যবিধি।

রোববার সকাল ৯টার দিকে খোলে জিন্দাবাজারের কানিজ প্লাজা, আল হামরা শপিংমল, ব্ল–-ওয়াটার, কাকলী শপিং সেন্টার, সিটি সেন্টার, শুকরিয়া মার্কেট, বন্দর বাজারের হাসান মার্কেট, আল মারজান, সিলেট প্লাজাসহ নগরীর অন্যান্য এলাকার মার্কেটগুলো। কিন্তু বেশিরভাগ মার্কেটের প্রবেশমুখে নেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। এ ছাড়া যে কয়েকজন ক্রেতা মার্কেটে প্রবেশ করছেন তাদের বেশিরভাগের মুখেই নেই মাস্ক। ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দোকানে ক্রেতার আগমন আগের মতো হচ্ছে না।

বগুড়া : বগুড়ায় করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও জনগণের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। শহরে টিসিবির পণ্য কিনতে শত শত নারী-পুরুষ ভিড় করছেন। মার্কেটগুলোয় যেন হাট বসেছে। দোকানি ও ক্রেতা কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।

রোববার দুপুর পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় এ জেলায় নতুন করে ১১৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময় ১৭ জন সুস্থ হলেও শাহীনুর আকন্দ (৫০) নামে এক ব্যক্তি বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে মারা গেছেন। বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান তুহিন এ তথ্য দেন।

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : রোববার সরেজমিন দেখা যায়, দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় ঢাকা ও এর আশপাশের জেলা শহরগুলো থেকে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ছোট ছোট যানবাহনে পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে আসছেন। সেখান থেকে গাদাগাদি করে ফেরি পার হয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে আসছেন। এখান থেকে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইজিবাইক, মাহিন্দ্র, মোটরসাইকেল, নসিমন, পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছুটছেন নিজ গন্তব্যে।

রাজধানীর হোটেল ব্যবসায়ী আফছার উদ্দিন বলেন, চলমান লকডাউনে এমনিতেই ব্যবসা মন্দা। তার ওপর চোর-পুলিশ খেলে ব্যবসা চালানোও অসম্ভব। তা ছাড়া সামনের কঠোর লকডাউন এবং রোজায় ব্যবসা এমনিতেই বন্ধ রাখতে হবে তাই আগেভাগেই স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরছি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয়ের (এজিএম) ফিরোজ শেখ বলেন, ঘাটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। সরকার লকডাউনের ব্যাপারে আরও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে পারাপার করতে।

লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) : শিমুলিয়া ঘাটে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে দ্বিগুণ। রোববার সকাল থেকে মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাটে দক্ষিণবঙ্গগামী ২১টি জেলার মানুষের ঢল দেখা গেছে। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় ভোগান্তির শিকার হয় যাত্রীরা। লঞ্চ, সিবোট ও ট্রলার বন্ধ থাকলেও ফেরিতেই যাত্রীদের পারাপার ছিল সারা দিন। মাদারীপুর জেলার হাসান আলী বেপারি জানান, ৯ বছর ধরে পরিবার নিয়ে ঢাকার মীরপুরে বসবাস করছেন। গত বছর করোনার সময় এলাকায় চলে আসেন। এরপর পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবার পরিবার নিয়ে ঢাকায় ফেরেন। এবার আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তিনি।