স্বপ্ন বাস্তবায়নে অবিচল ফরহাদ

আব্দুল্লাহ আল মারুফ


রাজশাহী তথা এ দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে নিদান ভদ্রলোক দের খোঁজ করলে যে নামটি প্রথমেই ভেসে উঠবে, তিনি হয়তো ফরহাদ হোসেন। ঠোঁটের কোনে সব সময়ই হাসি লাগিয়ে রাখা, আর চুপচাপ স্বভাবের জন্য সবার কাছে প্রিয় নামটিও ফরহাদ! ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং এ তিন বিভাগেই দ্যুতি ছড়িয়ে বেড়ানো ক্রিকেটারটিও ফরহাদ! আবার, জাতীয় দলের দুয়ারে প্রায় প্রতিটি বছর মাথা ঠুকে বেড়ানো দুর্ভাগা ক্রিকেটারটির নামও বুঝি এই ফরহাদ!

প্রথম শ্রেণী হতে শুরু করে সব পর্যায়ের ক্রিকেট খেলা ফরহাদ, মূলত তাঁর কুল হেডেড ক্রিকেট দিয়েই ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সকলকে মুগ্ধ করে রেখেছেন প্রায় দেড় যুগ। কখনো ব্যাটে, আর কখনোবা বলে, কোথায় নেই তিনি? বাংলাদেশ ‘এ’ দলে প্রতিনিধিত্ব করা ফরহাদ দীর্ঘদিন ধরে খেলছেন এনসিএল, বিসিএল, বিপিএল, ডিপিএল সহ দেশের সমস্ত এলিট শ্রেণীর ক্রিকেট!

বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশ তন্নতন্ন করে খুঁজে হাতে গোনা যেসব নক্ষত্র পাওয়া যাবে, সেই সকল নক্ষত্রদের একজন ফরহাদ হোসেন! যার প্রমান স্মৃতিতে আজও তরতাজা! ২০১৭ সালের ৬ মার্চ, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দেশের মাত্র পঞ্চম ক্রিকেটার হিসাবে সাত হাজার রানের মালিক বনে যান ফরহাদ!

১৪৩ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলা ফরহাদের রান প্রায় নয় হাজার! যেখানে রয়েছে ১৭টি সেঞ্চুরি! আছে ডাবল সেঞ্চুরিও। ২১৬ রাান, এ ফরম্যাটে তাঁর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর! করেছেন ৪৩ টি অর্ধশতক। এসবের পাশাপাশি বোলিং-ফিল্ডিংয়েও সমান উজ্জ্বল ছিলেন ফরহাদ! সমান সংখ্যক ম্যাচে ১৬০ টির বেশি উইকেট আছে তাঁর ঝুলিতে! যেখানে এক ইনিংসে ৬ উইকেট প্রাপ্তিই তাঁর সেরা বোলিং নৈপুণ্য! এ পর্যন্ত ১৭৯ টি ক্যাচ তালুবন্দী করেছেন ফরহাদ!

বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণী ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের রেকর্ডের পাতা উল্টালে যে নামটি অনেক উজ্জ্বল দেখা যায়, যে নামটি সবচেয়ে বেশী জ্বলজ্বলে, তিনিই ফরহাদ হোসেন। কেনোই-বা নামটি উজ্জ্বল দেখা যাবেনা? আর কেনোই-বা জ্বলজ্বল করবেনা? স্বীকৃত ক্রিকেটে এগারো হাজারের অধিক রান ও দুই শতাধিক উইকেট যার ঝুলিতে, তার নামটি-ই তো উজ্জ্বল দেখা যাওয়ার কথা সবচেয়ে বেশী! প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে, রাজশাহীর সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরির মালিক যিনি, তাঁর নামটিই তো সবচেয়ে বেশী জ্বলজ্বল করার কথা!

লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও বেশ সফল ফরহাদ! এখানেও তাঁর রয়েছে দুই হাজার এর অধিক রান এবং ৩০ টির অধিক উইকেট! মাত্র ১৬ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার, যেখানে তার সেরা সাফাল্য! এখানেও ফরহাদ হোসেনের রয়েছে ক্যাচের অর্ধশতক!

প্রথম শ্রেণী ও লিস্ট-এ ক্রিকেটে দুর্দান্ত খেলা ফরহাদের টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ তেমন মেলেনি। মাত্র ২৭ টি টি-টোয়েন্টি খেলা ফারহাদ ২১ ইনিংসে ব্যাট হাতে রান করেছেন ২৫৭ এবং ১৫ টি ইনিংসে হাত ঘুরিয়ে উইকেট পেয়েছেন ৯ টি, যেখানে সেরা সাফল্য মাত্র ১১ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট! এই ফরম্যাটে ক্যাচও নিয়েছেন ১০টি!

বিপিএলে রাজশাহী কিংস ও বরিশাল বার্নার্সের হয়ে মাঠে নামা ফরহাদ খেলেছেন দেশের বয়স ভিত্তিক দলে এবং সফর করেছেন বিশ্বের বহু দেশ! ইন্ডিয়া ট্যুর দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো! পরবর্তীতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৫ ১৭ ১৯ ও ‘এ’ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া, মালোয়েশিয়া সাউথ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ওয়েস্টইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড, শ্রীলংকা, ও দুবাই সফর করেন ফরহাদ।

সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লীগেও বেশ উজ্জ্বল ছিলেন ফরহাদ। ৪৫ গড়ে করেন ৪৮৫ রান! বিভিন্ন সময়ে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন দলের হয়ে টস করতে নামা ফরহাদ বেশ শক্ত হাতেই সবসময় নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিজ দলকে। কেবল বাংলাদেশ ‘এ’, প্রথম শ্রেনী কিংবা লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের বৃত্তেই আটকে থাকেননি ফরহাদ হোসেন!

১৯৮৭ সালে রাজশাহীতে জন্ম নেওয়া এই কৃতি ক্রিকেটার দুর্দান্ত প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরো বাংলাদেশ। নিজেকে সব সময়-ই ক্রিকেটের মাঝে ডুবিয়ে রাখতে খেলেছেন রাজশাহীসহ দেশের প্রায় সকল বিভাগ ও জেলার লীগ ও টুর্নামেন্ট! প্রথম স্তরের মত এই সকল স্তরেও বেশ সফল ফরহাদ!

এত এত মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে যাবার পরও কোন এক অজানা কারনেই জাতীয় দলের দরজাটা আজও অধরা রয়ে গেছে তাঁর কাছে! ব্যাটিং, বোলিং বা ফিল্ডিং দিয়ে দেশের সকল পর্যায়ের ক্রিকেটে সমান উজ্জ্বল, সেই সাথে এত এত সব রেকর্ডের মালিক ফরহাদের হয়তো ভাগ্য দোষেই আর ছোঁয়া হয়নি স্বপ্নের বাংলাদেশ জাতীয় দলে প্রবেশের স্বার্ণালী চাবি।

বয়স যেভাবে এগুচ্ছে, আর এ দেশের ক্রিকেট যে নীতি তে এগিয়ে চলছে (ছোট দের তৈরী করা নীতি), তাতে হয়তো সবখানেই দ্যুতি ছড়ানো এই প্রতিভার সুযোগ আর মিলবেনা, এ কথা আজ বলা-ই যায়! হয়তো এভাবেই অনাদর আর অবহেলায় ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবেন ফরহাদ।

এ তো গেলো অনুমানের কথা, হতাশার কথা! তবু সম্ভাবনা বলে তো একটি শব্দ অভিধানে থেকেই যায়! আর সেসব ক্ষুদ্র সম্ভাবনা গুলোকে সাথী করেই এগিয়ে যেতে চান ফরহাদ! প্রতিটি মৌসুমেই দাড়াতে চান নতুন করে, নতুন কোন স্বপ্নকে বুকে লালন করে। আর এভাবেই সব স্বপ্ন সত্যি করার লক্ষ্যে অবিচল থাকতে চান, যতদিন শরীর কথা বলবে, যতদিন দেহের রক্ত গুলোতে স্বপ্নের বারতা বয়ে যেতে থাকবে! যতদিন ক্রিকেটের প্রতি আত্মনিবেদন ও ভালোবাসাটা বুকের বাঁ-পাশের মাংশপিন্ডে অক্ষুন্ন থাকবে!