টিকা ছাড়া স্কুল খোলা ঝুঁকি বলছেন রাজশাহীর অভিবাবকরা

স্কুল খুলছে, শিক্ষার্থী-মনে আনন্দ-দোলা

শাহিনুল আশিক:

ঘনিয়ে আসেছে স্কুল খোলার দিন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামি ১২ সেপ্টেম্বর খুলে যাবে জ্ঞান অর্জনের স্কুল, আনন্দের স্কুল, বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক গড়ার স্কুল। স্কুল খুলছে, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ উদ্দীপনা বিরাজ করছে। তারা রোমাঞ্চিত আবার দেখা হবে প্রিয় শিক্ষকের সাথে, প্রিয় বন্ধুর সাথে, আবার ভরবে আনন্দবেলা।

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মাফিন খাতুন জানায়, ‘বাড়িতে লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না। মাঝে মধ্যে স্কুলের বাড়িতে লেখা অ্যাসাইমেন্ট জমা দিয়ে আসি। স্যারের (শিক্ষক) সাথে ও বান্ধবীদের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না, কথা হয় না। স্কুল খুললে সবাই মিলে অনেক মজা করবো।’

জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় ১ হাজার ৫৮টি সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর ৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে কয়েকটি ঘুরে দেখা গেছে- প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও বিভিন্ন কেনাকাটা, পানির ট্যাপ স্থাপন এখনও পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি। কয়েকজন স্কুল প্রধান জানান, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন কেনাকাটা সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলো দ্রুত শেষ করা হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত পানির ট্যাপ স্থাপন করার কাজ চলমান রয়েছে স্কুলগুলোতে।

এদিকে, করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধিসহ সরকারের বেধে দেওয়া নির্দেশনা পালনের বিষয়ে নগরের নামোভদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আঞ্জুমান আরা জানান, ‘দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ ছিল। তাই প্রথমেই শ্রমিক দিয়ে পুরো বিদ্যালয় চত্বর ও এর চারপাশ পরিস্কার করেছি। সেই সঙ্গে আগাছাসহ গাছের ডালপালা কাটা হয়েছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার লক্ষ্যে।

তিনি বলেন, সরকার পরিকল্পনা করছে প্রত্যেক শ্রেণির এক-একদিন করে ক্লাস নেয়ার। প্রতিষ্ঠানে অনেকগুলো ক্লাস রুম রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী এক বেঞ্চে বসবে। এভাবে দুই থেকে তিনটি রুমে তাদের ক্লাস করানো হবে। সেই সঙ্গে মাস্ক পরা ছাড়াও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।’

নগরের বুধপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সব ক্লাস রুম ধোয়ামোছা হয়েছে। পানি শুকাতে ফ্যান চালানো হচ্ছে। এই স্কুলে প্রাক প্রাথমিক মিলে ২৯০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

স্কুলের সহকারী শিক্ষক রুহুল আমিন জানান, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। স্কুলের ভেতরে-বাইরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থার পাশাপাশি ট্যাপের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সাবান, মাস্ক কেনা হয়েছে। আগে থেকেই রয়েছে তাপমাত্রা মাপার মেশিন।’

তবে টিকার আগে স্কুল খোলা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক অভিভাবকই ঝুঁকির বিষয়টি সামনে এনেছেন। তবে তারা স্কুল খোলার ব্যাপারে একমত। বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারটিকে তারা অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। অভিভাবক মামুন-অর-রশিদ বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া হয়নি। টিকার কার্যক্রম সম্পন্নের আগে স্কুল খোলা অনেকটাই ঝুঁকি থেকে যায়। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের এখন সেই জ্ঞান হয়নি, যে তারা একে অপরের সাথে মিশবে না, খেলাধূলা করবে না, নাকে-মুখে হাত দেবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।’

এছাড়া বেলা ১১ টার দিকে ভদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, করোনা টিকার দীর্ঘ লাইন। স্কুলে প্রবেশের গেটের পাশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাত ধোয়ার বেসিনে থাকা তিনটি পানির ট্যাপের মধ্যে একটি ভাঙ্গা। এগুলি অপরিস্কার অবস্থায় রয়েছে। তবে স্কুলে টিকাদান কর্মসূচি চলমান থাকায় গেটে থাকা কাউন্সিলরের কর্মী জানান, ‘অফিস বন্ধ। কোনো শিক্ষক নেই।’

রাজশাহী উপশহর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ক্লাসরুম পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে কর্মিরা। স্কুলের শিক্ষকরা জানান, তাদের তাপমাত্রা মাপার মেশিন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাস্ক সরবারহ করা হবে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে, অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে রমজান আলী, সেলিম ও জীবন নামের তিন কর্মী ক্লাস রুম পরিস্কার করছেন। একই সঙ্গে তারা ক্লাসের ব্রেঞ্চ, ব্লাক বোর্ড, ফ্যান ও মেঝে পরিস্কার করছেন। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকজন শ্রমিক প্রতিষ্ঠানটির মাঠ ও আশে পাশের ঝোপ-জঙ্গল পরিস্কার করছেন।

অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম জানান, এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা এসেছিল। তখনও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত ছিলাম। এবারও শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা শোনার পরেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। দুই-তিন দিনের মধ্যেই পুরো কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেন- মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনা হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী মাস্ক ছাড়া আসলে তাকে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া দুইটি গেট খোলা থাকবে। সেখানে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে হাত ধোয়ার। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে এক সাথে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী হাত ধুতে পারবে।

অভিভাবক শফিউর রহমান জানান, ক্লাসে বসে লেখাপড়ার মজাটা ভুলে গেছে শিক্ষার্থীরা। তবে আগ্রহ আছে- স্কুলে আসার, ক্লাস করার। মেয়ে স্কুলে অ্যাসাইমেন্টের একটু কাজ ছিলো। এসেছি সকালে, কিন্তুতো মেয়ে বাড়ি যেতে চাচ্ছে না!

স্কুল খোলার প্রস্তুতি ও শিক্ষকদের টিকা নেয়ার বিষয়ে রাজশাহী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষক টিকা নিয়েছেন। বাকি পাঁচ শতাংশের মধ্যে রয়েছে- সন্তানসম্ভবা, যাদের শিশুরা দুধ খায় ও যে সকল শিক্ষকরা গুরুতর অসুস্থ। তারাই কেবল টিকা নেননি।’

তিনি বলেন, রাজশাহীর ১ হাজার ৫৮টি সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় প্রস্তুত রাখতে প্রধানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তারা সেই মোতাবেক কাজও করেছে। এনিয়ে উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের দিয়ে স্কুল পরিদর্শনও করা হয়েছে। তাতে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেছে। এছাড়া নিজেও জেলা পুঠিয়ার দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছি, সন্তোষজনক ছিল।