সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন: শিরোপার চেয়ে বেশি কিছু জয়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

এমন একটি দিনের অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশের সাবিনারা। বয়সভিত্তিক ফুটবলে শিরোপা জেতা বাংলাদেশ দলের কাছে সিনিয়র পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল আকাশের চাঁদ। গতকাল কাঠমাণ্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে সেই আকাশই ছুঁয়ে দিলেন বাংলাদেশের মেয়েরা, কৃষ্ণার জোড়া গোল আর শামসুন্নাহারের ম্যাজিকে।

স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়ে সাফ ফুটবলে প্রথমবার লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন মেয়েরা, যাঁরা এই গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি।

একসময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য ছিল যাঁদের নিত্যসঙ্গী, সেই মেয়েদের হাতেই আজ উড়ছে ফুটবলের পতাকা।

বাংলাদেশ দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনও সহায়-সম্বলহীন মেয়েদের পরিশ্রমে গড়া শিরোপাসৌধের কথা বলেছেন, ‘এই মেয়েরা এসেছে খেটে খাওয়া পরিবার থেকে। ফুটবল না হলে হয়তো তারা অন্য কিছু করত গ্রামের বাড়িতে। ফুটবলের সৌভাগ্য তাদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে, এর বিনিময়ে এই মেয়েরাও ফুটবলকে দুহাত ভরে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ’

কাল দশরথ স্টেডিয়ামে সাবিনা-কৃষ্ণারা রচনা করেছে অসম্ভবের গল্প। তবে দশরথ বলেই ভয় ছিল। ঘরের মাঠে গ্যালারি উপচে পড়ে, নেপালি সমর্থকদের চিল-চিৎকারে প্রতিপক্ষ দলের খেলায় মনোযোগ ধরে রাখা যেন দ্বিতীয় লড়াই। এই উত্তুঙ্গ সমর্থনও গতকাল তাতিয়ে রাখতে পারেনি রেশমি-অনিতাদের। জীবনযুদ্ধে জয়ী সাবিনা-মনিকা-শামসুন্নাহার-কৃষ্ণারা গ্যালারির প্রতিকূল স্রোতের বিপক্ষে সাঁতরে তীরে উঠেছেন অবলীলায়।

ছোটবেলা থেকেই তাঁরা জীবনসংগ্রামের মধ্যে এবং ফুটবলই দিয়েছে তাঁদের নতুন জীবনের দিশা। সেখানে দশরথের ভয়ে তাঁরা কুঁকড়ে যাওয়ার মেয়ে নন। দলের উইঙ্গার সানজিদা যেমন ম্যাচের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, ১১ জনের যোদ্ধা দল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব। ’

এমন সংগ্রামী জীবন বৃথা যেতে পারে না ফুটবলে। উল্টো লাল-সবুজের ফুটবলকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই বেছে নিয়েছেন তাঁরা কাঠমাণ্ডুর এই ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামকে, যে মাঠে ১৯৯৯ সাফ গেমস ফুটবলে প্রথম সোনা জিতেছিল দেশের ছেলেদের দল। কাকতালীয়ভাবে মেয়েদের ফুটবলের নতুন আখ্যানও শুরু হলো একই মাঠে, প্রতিপক্ষও নেপাল!

কাঠমাণ্ডুর এই স্টেডিয়ামকে পয়মন্তই বলতে হবে বাংলাদেশের জন্য। ১৩ মিনিটেই শামসুন্নাহার ম্যাজিকে যতি পড়ে গ্যালারির উৎসবে। মিনিটখানেক আগেই তিনি মাঠে নেমেছেন চোট পাওয়া স্বপ্নার বদলি হয়ে। বলে শামসুন্নাহারের প্রথম ছোঁয়াতেই রাঙিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। ডান দিক থেকে মনিকা চাকমার হাওয়ায় ভাসানো বলটি ‘ফ্লিক’ করে নেপালি গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে তিনি পাঠিয়ে দেন দূরের পোস্টে। ছোটখাটো গড়নের শামসুন্নাহারের পায়েও যে এমন সৌরভ ছিল, সেটা আগে দেখা যায়নি এই টুর্নামেন্টে।

গোলের লিডে থেমে থাকার নয় এই মেয়েরা। সেই গোল ধরে রাখতে রক্ষণাত্মক হয়ে পড়বেন, সেটাও নয়। আরো গোলের নেশায় তাঁরা ছুটেছেন দাপটের সঙ্গে। এই আক্রমণাত্মক খেলার কারণে ম্যাচের রাশও কখনো হাতছাড়া হয়নি। থিতু হতে পারেনি নেপালিরা। ২৭ মিনিটে নেপালের একটি শট রূপনা চাকমা দ্বিতীয় চেষ্টায় গ্রিপে নেওয়ার সময় প্রথমার্ধে আরেকবার বিপদের ছায়া পড়েছিল বাংলাদেশের গোলসীমায়। ৩৬ মিনিটে গোল লাইন থেকে আশঙ্কার সেই মেঘ সরিয়েছেন মাশুরা। কয়েক মিনিটের এই ঝলকে উত্তাল দশরথের গ্যালারি চুপসে যায় ম্যাচের ৪২তম মিনিটে। সাবিনা বাড়িয়েছেন দুর্দান্ত এক থ্রু বল, সেটি ধরে টাঙ্গাইলের মেয়ে কৃষ্ণা বাঁ পায়ে দুর্দান্ত ফিনিশ করে ম্যাচের ভাগ্য একরকম গড়ে দেন প্রথমার্ধেই।

ম্যাচের আরো ৪৫ মিনিট বাকি থাকলেও লাল-সবুজের মেয়েদের খেলায় কখনো আশাভঙ্গের ইঙ্গিত ছিল না। বরং প্রতিটি বিভাগে সুস্পষ্ট আধিপত্য ছিল তাদের। দুই বছর আগে যারা বিরাটনগরে নেপালের সঙ্গে লড়তেই পারেনি, সেই দলটিই গতকাল কর্তৃত্ব করেছে নেপালের মাঠে। টেকনিক-ট্যাকটিকসে নেপালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত তাদের প্রতিটি আক্রমণে। তবু একটু ‘খুঁত’ ছিল, ৪০টি আন্তর্জাতিক গোলের মালিক সাবিত্রা শুরুর একাদশে ছিলেন না চোটের কারণে। তাঁর অনুপস্থিতিই কি সাবিনাদের পথ সুগম করে দিল? সেই প্রশ্নেরও উত্তর মিলে গেছে। দ্বিতীয়ার্ধে সাবিত্রা মাঠে নেমেছেন, তাতে উজ্জীবিত নেপাল একবার ব্যবধান কমালেও সেটি আবার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ।

দুই গোলে পিছিয়ে পড়া নেপালের দ্বিতীয়ার্ধে মরিয়া আক্রমণে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। স্বভাবতই কিছুটা রক্ষণাত্মক তখন বাংলাদেশ। তাই দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর পরের কিছুটা সময় বাংলাদেশের সীমানায় বল ঘুরেছে বেশি। নেপাল একবার ব্যবধানও কমিয়েছে ৭০তম মিনিটে। বাঁ দিক থেকে আক্রমণে ওঠার পর অনিতা বাসনেতের কোনাকুনি শটে রূপনা চাকমা পরাস্ত হয়েছেন। যথারীতি স্টেডিয়ামে নতুন করে হুল্লোড় ওঠে। গ্যালারির অনুপ্রেরণাকে শক্তি করে প্রাণপণ ঝাঁপিয়েছিল নেপাল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যা হয়, একটি প্রতি-আক্রমণ থেকে নেপালের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে বাংলাদেশ। ম্যাচে ফিরতে উন্মত্ত নেপালের রক্ষণভাগ অরক্ষিত। সেই সুযোগে ৭৮ মিনিটে চমৎকার একটি পাল্টা আক্রমণ থেকে গোল করেছেন কৃষ্ণা। মনিকার বাড়ানো বল নিয়ে বক্সে ঢুকে নিখুঁত ফিনিশ করেছেন তিনি। শেষ হয়ে যায় নেপালের লড়াইয়ের শক্তি। একটু পর রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই উৎসবে মেতে ওঠেন মেয়েরা, দূর থেকে যা আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। গ্রামবাংলার একদল মেয়ের ফুটবল জয়ের মধ্য দিয়ে তারা জীবনের, সমাজের প্রতিকূলতাকেও জয় করেছে। ‘সবুজ ঘাস স্পর্শের সুযোগ’ পেয়ে তারা আকাশের নীলকে ছুঁয়েছে।

 

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ