সাপ উদ্ধারে সাপ প্রেমিক রাবি শিক্ষার্থী মিজানের অনন্য উদ্যোগ 

গোলাম রব্বিল, রাবি:

নেই কোনো ডর কিংবা ভয়। হাতে সাপ ধরার হুক। নিয়েছেন প্রশিক্ষণ। মানুষের হাত থেকে বাঁচাতে অনায়াসেই উদ্ধার করছেন বিষাক্ত সাপ। বলছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী মিজানের কথা। সাপের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মানুষের হাত থেকে সাপ উদ্ধার করে নিরাপদ পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

মিজানুর রহমান (মিজান) রাবির ম্যানেজমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। যুক্ত আছেন ডিপ ইকোলজি এন্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন নামের সাপ ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের সাথে। সংগঠনটির একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি তিনি। গ্রামের বাড়ি ঢাকার জেলার কেরানিগঞ্জ উপজেলার রসুলপুর গ্রামের জিনজিরা ইউনিয়নে। বাবা মঞ্জুর হোসেন ও তাসলিমা বেগমের বড় ছেলে তিনি।

পরিবেশ রক্ষায় মিজানের এমন উদ্যোগে ক্যাম্পাসে সবাই তাকে এক নামে চেনে। কিন্তু কাজটা এতটা সহজ ছিলো না তার। এই সাপ ধরার গল্প নিয়ে কথা হয় প্রকৃতি প্রেমিক মিজানের সঙ্গে। এমন উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মিজান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাপের গুরুত্ব বিবেচনায় এমন উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথমদিকে এই উদ্যোগকে মজার ছলে উড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীরা। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিইনি। তবে এখন সবার কাছ থেকে উৎসাহ পাই। সাপ উদ্ধার করতে পারলে আমার মধ্যে এক ধরনের ভাল লাগা কাজ করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইক্যুলজিক্যাল ব্যালেন্স রাখতে সাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ইক্যুলজিক্যাল ব্যালেন্স মানুষের বেঁচে থাকতে খুব দরকার। সাপ খুবই নিরীহ একটা প্রাণী। পৃথিবীর মোট সাপের চারভাগের একভাগ বিষাক্ত হ‌ওয়া সত্ত্বেও মানুষ সাপ দেখলে ভয়ে পালায়। মেরে ফেলে। নিজের ক্ষতির আশঙ্খা না থাকলে কাউকে কামড়ায় না সাপ। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মানুষকে সাপ না মারতে আহ্বান করতাম। কেউ সাড়া না দেওয়ায় নিজেই এদেরকে উদ্ধার করে প্রকৃতির কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

মিজান জীবনে প্রথম সাপ উদ্ধার করে রাবির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের ভিতরে জমে থাকা বৃষ্টির পানি থেকে। সালটা ছিলো ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর। সবুজের অভয়ারন্য ৭৫৩ একর আয়তনের রাবি ক্যাম্পাসে রয়েছে অনেকগুলো ডোবা, নালা, পুকুর, ঝোঁপঝাড়। হারহামেশাই এখানে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ চোখে পড়ে। কখনো ঝোঁপঝাড় বা কখনো লোকালয়ে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এসব সাপের মধ্যে রয়েছে- খৈয়া গোখড়া, ঘরগিন্নি, বেত আছড়া, হেলে, মেটে, জল ঢোড়াসহ নানা রকমের প্রজাতি।

সাপ যেখানেই বিপদে পড়ুক, তাকে উদ্ধার করা যেনো মিজানের দায়িত্ব। সেটা হোক ক্যাম্পাস, নিজ এলাকা অথবা ঘুরতে যাওয়া কোনো শহর। ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট তার নিজ উপজেলা ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে জলঢোড়া, চিত্রিত ঢোড়া ও একটি মেটে সাপ উদ্ধার করে। কিছুদিন ৩০ আগস্ট কেরানিগঞ্জের বিসিক শিল্প নগরী এলাকা থেকে একটি হেলে সাপ উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেন তিনি।

ক্যাম্পাসে বিনা কারণে কোনো সাপ হত্যা না করে উদ্ধারের জন্য তাকে ডাকার আহ্বান জানিয়ে পোস্টারও সাঁটিয়েছেন মিজান। ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর করোনার পর রাবির প্রত্যেকটি হলে তিনি সাপ বিষয়ক সচেতনামূলক পোস্টার সাঁটান। এতে শিক্ষার্থীদের সাপ না মেরে উদ্ধারের জন্য ফোন করার আহ্বান করা হয়। এছাড়াও সাপ হত্যা বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্যাম্পাসে এ সকল প্রচার-প্রচারণায় সাড়া দিয়ে প্রথম সাপ রেসকিউয়ের জন্য মিজানকে কল করা হয় বেগম খালেদা জিয়া হল থেকে।

সেখানে উদ্ধারের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি ঘরগিন্নি সাপ ডাইনিংয়ের জানালার ফ্রেমের ভিতর ঢুকে ছিলো। পরবর্তীতে ফ্রেম ভেঙ্গে সাপটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করি। পরে রাতেই নিরাপদ স্থানে অবমুক্ত করি।’

এরপর থেকে মাদার বখস হল, তাপসী রাবেয়া হল, শহিদ শামসুজ্জোহা হল, চারুকলা অনুষদ, পরিববন মার্কেট থেকে একে একে ১১ টি সাপ উদ্ধার করি করে মিজান। ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি মোট ৫টি সাপ উদ্ধার করেছেন। যার মধ্যে একটি খৈয়া গোখড়া সাপও রয়েছ। যার কামড়ে ৫-৬ ঘন্টার মধ্যে অনায়াসেই মারা যায় মানুষ।

এছাড়াও এ বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে সাপসহ প্রকৃতি নিয়ে ভাবা ও কাজ করতে ইচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন শিক্ষার্থীকে ডিপ ইকোলজি এন্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনে সাধারণ মেম্বার হিসেবে যুক্ত করেন মিজান। ভবিষ্যতে এই উদ্যোগ চালু থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এএইচ/এস