বুধবার , ৫ জুলাই ২০২৩ | ১৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং সিধু -কানুর আত্মত্যাগ

Paris
জুলাই ৫, ২০২৩ ৮:৩৭ অপরাহ্ণ

মোঃ কায়ছার আলী :

Man can be destroyed but never Defeated হতে পারে কিন্তু পরাজয় বরণ করতে পারে না।বিশ্ববরেণ্য নোবেলজয়ী,মার্কিন ঔপন্যাসিক, স্বেচ্ছায় আত্মহত্যাকারী আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে তাঁর অমর গ্রন্থ ঞযব ড়ষফ সধহ ধহফ ঞযব ংবধ এ হাওয়াই দ্বীপবাসীদের বীরত্বকে স্মরণ করে রাখার জন্য এ অসাধারণ বাক্যটি লিখেছেন।

আমেরিকার ৫০ তম অংগরাজ্য হাওয়াই (রাজধানী হনলুলু)। মূল ভূখন্ড থেকে অনেক দুরে জাপানের কাছাকাছি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ। সবদিক থেকে উর্বশীর চেয়ে অপরুপ সুন্দরী এই দ্বীপ আক্রান্ত হলে দ্বীপবাসীরা অসম যুদ্ধে না জড়িয়ে, তাঁদের পরাজয় বরণ ঠেঁকাতে তাঁদের রাজার ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে স্বেচ্ছায় সুউচ্চ পাহাড়ে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালায় নিচে গভীর খাদে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদেরকে আত্মোৎসর্গ করলেন।ইতিহাসে চিরভাস্মর তাঁদের ত্যাগের মহিমা।ভারতবর্ষের হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য সমগ্র ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা উদ্ধার করেন। গত সপ্তাহে দিনাজপুর ডি সি অফিস (কাঞ্চন -১) কক্ষে এন,জি,ও র একটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে সিঁড়িতে ঊঠার সময় দেখলাম নীচতলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত একটি সুন্দর কক্ষ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলতে আমরা পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বুঝি। তাদের জীবন ও জীবিকা সাধারণত খাদ্য সংগ্রহ, উদ্দ্যোন, কৃষি ও পশুপালনের উপর নির্ভরশীল।

এদেশে ৯৩ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস যেমন চাকমা, মারমা, মুরং, মনিপুরী,সাঁওতাল ইত্যাদি। সাঁওতালকে কেউ কেউ আবার আদিবাসীও বলে। এই আদিবাসীদের মধ্যে সিধু -কানুর মত বীরপুরুষ রয়েছে। তাঁদের ভাস্কর্য আমার ভালবাসার মহেশপুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়, বোঁচাগঞ্জ, দিনাজপুরে প্রাঙ্গনে ও কান্তনগর (রাস্তার তে-মাথায়) কাহারোল,দিনাজপুরে চেতনার প্রেরণা হিসেবে তীরধনুক হাতে দন্ডায়মান। সিধু -কানুদের নেতৃত্বে সাঁওতালরা ইংরেজদের শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। তাঁরা সরাসরি বিজয়ী না হলেও তাঁদের বিদ্রোহ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার তাঁদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং বসবাসের জন্য তাঁরা সাঁওতাল পরগণা নামে নতুন জেলা গঠন করে। জমির মালিকানার অর্জনের সাথে মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল করে। তাঁদের বীরত্বের সুদুরপ্রসারী ফলাফল হল কৃষক সংগ্রাম ও সিপাহী বিদ্রোহের প্রেরণা। সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব ছিলেন চার ভাই। সাঁওতাল পরগণার ভাওলাদিহি গ্রামের দরিদ্র আদিবাসী পরিবারে তাঁদের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের অপমান ও পীড়ন দেখে দেখে তাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন কিভাবে ঋণের ফাঁদে, দাদন ব্যবসায় বংশ পরম্পরায় নি:স্ব হতে হয়। প্রতিবাদ করলে গ্রেফতার হয়রানি ও ব্রিটিশ সরকারের উল্টো খড়গ নেমে আসা।

ধূর্ত ব্যবসায়ীরা জমিদার ও ইংরেজ সরকারের সহায়তায় সহজ সরল সাঁওতালদের কাছ থেকে ধান,সরিষা ও তৈলবীজ নিয়ে তাঁদের দিত অর্থ, লবণ, তামাক ও কাপড়। সেগুলো নেওয়ার সময় বড় বাটখারা ‘বড় বৌ’ বা কেনারাম দিয়ে ওজনে বেশি নিয়ে দেওয়ার সময় ছোট বাটখারা ‘ছোট বৌ’ বা বেচারাম দিয়ে দুপাশেই ঠকাত। চাষাবাদের সময় ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত সুদে ঋণ দিয়ে দাদন ব্যবসায় বাধ্য করে কৌশলে সই বা টিপ নিত। নানারকম অত্যাচার নির্যাতন ও উৎপীড়ন করে তাঁদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে বাধ্য করত। তাঁদের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠায় তাঁরা মুক্তির পথ খুঁজতে লাগলো। আদিবাসীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং প্রকৃতির সংগে লড়াই করা তাঁদের স্বভাব। যে মাটিতে কোন মানুষের পা পড়েনি,হিংস্র প্রাণী ,পোকামাকড় আর সাপ বিচ্ছু ভরপুর সেখানে তাঁরা বসবাস এবং চাষাবাদ করে,সোনার ফসল ফলায়।ইংরেজ সরকার তাঁদেরকে বলেছিল “তোমরা দূর্গম অঞ্চলের জঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাদ ও বসবাস কর।

আমরা সেই অনাবাদী জমিতে কোন কর ধার্য্য করব না” তাঁরা তাঁদের সেই কথা পরবর্তীতে আর রাখেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ১৭৮০ দালে তিলকা মুরমু (মাঞ্জহী) প্রথম গণসংগ্রামের সূচনা করেন। ১৭৮৪ সালে ১৭ জানুয়ারী তাঁর তীরের আঘাতেই ভাগলপুরে ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৮১১ সালে দ্বিতীয় বার, ১৮২০ সালে তৃতীয় বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থ বার গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে। অবশেষে ১৮৫৫ সালে ৩০ শে জুন সিধু -কানুর ডাকে ৪০০ গ্রামের ৩০ হাজারের অধিক সাঁওতাল একত্রিত হয়ে ভারতের ইতিহাসে প্রথম কলকাতা অভিমূখে পদযাত্রা বা গণমিছিল করেন। তাঁদের সমবেত কন্ঠে উচ্চারিত হয় “জমি চাই,মুক্তি চাই” শ্লোগান। পদযাত্রার সময় অত্যাচারী মহাজন কেনারাম ভগত ও জঙ্গিপুরের দারোগা মহেশ লাল দত্ত ৬/৭ জন সাঁওতাল নেতাকে গ্রেফতার করেন। সিধু -কানুকে গ্রেফতার করতে উদ্যত হলে বিপ্লবীরা ৭ই জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহাজন কেনারাম ও দারোগা মহেশ লাল সহ তাঁদের দলের ১৯ জনকে হত্যা করে। বিপ্লবীরা বীরভূমের বিখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র নাগপুর বাজার ধ্বংস করে এবং ২১ শে জুলাই কাতনা গ্রামের ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের কাছে পরাজয়ের স্বিকার করে।

এমতাবস্থায় ইংরেজ বাহিনী ডাইরেক্ট আ্যকশেন শুরু করে। সেই আগুনের দাবানল টানা আটমাস যাবৎ চলে। ইংরেজরা হাজার হাজার সাঁওতালকে এলোপাথাড়ি ভাবে হত্যা করে। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে সিধুর গোপন আস্তানায় হানা দিলে সেই লড়াইয়ে সাঁওতাল বিদ্রোহের মহানায়ক সিধু পুলিশের গুলিতে নিহত নিহত হন। দ্বিতীয় সপ্তাহে একদল সশস্ত্র বিদ্রোহী সহ কানু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। আদালতের বিচারে কানুকে ফাঁসি দেওয়া হওয়া হয়। তাঁদের দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব ভাগলপুরের কাছে এক ভয়ানক যুদ্ধে বীরের মত প্রাণ ঊৎসর্গ করেন।

সে সময় সাঁওতাল নারীদের নিয়ে বিপ্লব করেছিল দুইবোন ফুলো মুরমু ও ঝানো মুরমু। ফুলো মুরমুকে ব্রিটিশ সিপাহিরা নৃশংসভাবে ধর্ষন ও হত্যা করে, তাঁর লাশ রেললাইনে ফেলে দেয়। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে সাঁওতাল জাতিসত্তা তাঁকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর সাঁওতালদের লাল রক্তে সবুজ শ্যামল মাটি রঞ্জিত হয়। প্রতিবছর তাঁদের স্মৃতি ও স্মরণে ৩০ শে জুন যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয় “হুল দিবস”। ক্ষুদ্র জাতি সত্তার সকল বীর এবং বীরাঙ্গনাদের আত্মার প্রতি অতল + গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রিয় দেশাত্মবোধক গানটি উৎসর্গ করে কলমটি থামালাম “মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

01717-977634, kaisardinajpur@yahoo.com

সর্বশেষ - মতামত