সরকারের এক সফটওয়্যার বানাতেই ব্যয় সাড়ে ৪৭ কোটি টাকা!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও প্রকল্পের গাড়িসহ অন্যান্য সরঞ্জামের তথ্য এক জায়গায় পাওয়া ও সংরক্ষণের (ডাটাবেইস) জন্য ২০১৮ সালে একটি প্রকল্পের আওতায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে সফটওয়্যার কেনা হয়। কিন্তু সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে নিয়মিত তথ্য হালনাগাদ না করায় ওই ডাটাবেইস আর তৈরি হয়নি। কাজে লাগেনি সফটওয়্যারটিও। ফলে প্রকল্পসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কত গাড়ি আছে, কত জ্বালানি খরচ হচ্ছে, তার কেন্দ্রীয় কোনো হিসাব নেই।

সম্প্রতি সরকারের ঘোষিত কৃচ্ছ্রসাধন নীতির আলোকে সরকারি ও প্রকল্পের গাড়িতে কত জ্বালানি খরচ হয় এবং কিভাবে জ্বালানি সাশ্রয় করা যায়, সে আলোচনা সামনে আসে। গাড়ির জন্য সরকারের জ্বালানি বাজেটের ২০ শতাংশ কমানোর নির্দেশনাও জারি করে অর্থ বিভাগ। এবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর আবার বিষয়টি আলোচনায় আসে।

এ অবস্থায় একই ডাটাবেইস তৈরির জন্য নতুন করে সফটওয়্যার কিনতে যাচ্ছে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ডিজিটাইজিং ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড পাবলিক প্রকিউরমেন্ট প্রজেক্ট (ডিআইএমএপিপিপি) নামের এই প্রকল্পের পরিচালক ও সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের মহাপরিচালক শোহেলের রহমান চৌধুরী বলেন, নতুন সফটওয়্যার তৈরির জন্য ৪৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এর ফলে প্রকল্পের সব সম্পদ অনলাইনে দেখা যাবে।

নতুন ডাটাবেইসে ১৫ বছরের আগের প্রকল্পের গাড়ির তথ্যও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। এ জন্য শেষ হওয়া প্রকল্পের যানবাহন জমা, ব্যবহার ও নিষ্পত্তিসংক্রান্ত পরিপত্র সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব নবীরুল ইসলাম বলেন, ‘সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গাড়িগুলো কোথায় কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা-ও জানি না। এবার কঠিন নিয়ম করা হচ্ছে। ১৫ বছরের আগের প্রকল্পেরও গাড়ি জমা দিতে হবে। এ জন্য পরিপত্র সংশোধন করা হচ্ছে। ’

গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, এখন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ছোট-বড় এক হাজার ৮১৯টি প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পের গাড়ির সঠিক সংখ্যা সরকারের কাছে নেই। ফলে জ্বালানি সাশ্রয়ের পরিকল্পনা করারও সুযোগ নেই। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবহন পুলের কর্মকর্তারা বলছেন, গাড়ির সংখ্যা আনুমানিক ৩০ হাজার হতে পারে।

৩০ থেকে ৫০ হাজার গাড়ির রিয়াল টাইম হিসাব রাখার একটি সফটওয়্যার বানাতে কত খরচ হয়—এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি প্রতিষ্ঠিত সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ প্রাযুক্তিক সুবিধা দিয়ে এমন একটি সফটওয়্যার তৈরিতে বড়জোর ছয় কোটি টাকা খরচ হতে পারে।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি সব প্রকল্পের তথ্য অনলাইনে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর স্ট্রেংদেনিং মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ক্যাপাবিলিটিজ অব আইএমইডি (এসএমইসিআই) প্রকল্পের অধীনে সাত কোটি টাকা খরচ করে প্রজেক্ট ম্যানেজমন্টে ইনফরমেশন সিস্টেম (পিএমইএস) নামের একটি ওয়েবসাইট কেনা হয়েছিল। ইনফরমেশন, এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন নামের একটি কম্পানি ওই সফটওয়্যার সরবরাহ করে।

ডাটাবেইস তৈরির জন্য তথ্য সরবরাহ করতে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে একজন করে কর্মকর্তাকে ফোকাল পারসন হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সফটওয়্যার ব্যবহারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয় আইএমইডি। কিন্তু বেশির ভাগ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রকল্পের তথ্য প্রদান করেননি। ফলে এক বছর পর ২০১৯ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের একাধিকবার চিঠি দিয়ে তথ্য সরবরাহের জন্য বলা হয়। চিঠিতে নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কিন্তু ২০২২ সালে এসেও প্রকল্পের গাড়ির ডাটাবেইস তৈরি হয়নি। ফলে কাজে লাগেনি পিএমআইএস সফটওয়্যারটি।

একই ডাটাবেইস তৈরির জন্য এবার নতুন প্রকল্প

গাড়ির ডাটাবেইস তৈরির জন্য এবার নতুন একটি প্রকল্প নিয়েছে আইএমইডি। আগের প্রকল্পের নাম ছিল পিএমআইএস। নতুন প্রকল্পের নাম ইপিএমআইএস। যুক্ত হয়েছে শুধু ইলেকট্রনিক শব্দটি। এর জন্য খরচ হবে ৪৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এবার কাজ পেয়েছে দোহাটেক। সফটওয়্যারটি আগামী মাসের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করতে চায় তারা। ডিজিটাইজিং ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড পাবলিক প্রকিউরমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় এটি বাস্তবায়িত হবে।

আগের পিএমআইএস সফটওয়্যারে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক ড্যাশবোর্ডের ব্যবস্থা ছিল। এতে রিয়াল টাইম তথ্য জানার ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তা ব্যবহারই করা যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য সরবরাহ না করায়।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ির তথ্য মন্ত্রীদের দেওয়া হয় না। স্থানীয় সরকার বিভাগে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৪৪টি প্রকল্পের মধ্যে ১০টির বেশি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সে সম্পর্কেও তাঁর কাছে তথ্য নেই। তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটিতে থাকার সময়ও প্রকল্পের গাড়ি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তার পরও কোনো তথ্য আসেনি।

জানতে চাইলে আইএমইডির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-৪-এর মূল্যায়ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাহবুব হোসেন বলেন, তিনি সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্প পরিচালক আগের সফটওয়্যার ব্যবহার করেননি। আবার বারবার পিডি পরিবর্তন হওয়ায় তথ্য সমন্বয় করা যায়নি ।

মাহবুব হোসেন জানান, আগের সফটওয়্যার খুব একটা কাজে আসেনি। তাতে অনেক বিষয় যুক্ত করাও ছিল না। এখন ইপিএমআইএস নামের নতুন সফটওয়্যার করা হচ্ছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

এসএমইসিআই প্রকল্পের উপপরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে সফটওয়্যারের ত্রুটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি বলতে পারব না। তবে আগের সফটওয়্যারটি বাদ দিয়ে এখন নতুন সফটওয়্যার করা হচ্ছে। আগের সফটওয়্যার তৈরি করেছিল আইইসিএল, এখন দোহাটেক তৈরি করছে। ’

আইএমইডির পরিচালক ও নতুন সফটওয়্যার তৈরির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য তৈয়বুর রহমান বলেন, এবার গাড়ি ব্যবহার সংক্রান্ত পরিপত্র সংশোধন করে সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। তবে তিনি বলেন, নতুন সফটওয়্যারে নতুন প্রকল্পের তথ্য নেওয়া সহজ হবে। কিন্তু সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ির তথ্য নেওয়া যাবে না। কারণ সমাপ্ত প্রকল্পের সব গাড়ির তথ্য আইএমইডিতে সংরক্ষিত নেই।

এই প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, নতুন প্রকল্পের গাড়ি কেনার তথ্য সরাসরি ইপিএমআইএস সফটওয়্যারে আসবে। কিন্তু সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ির তথ্য আসবে কি না, তা নিয়ে তাঁদের সন্দেহ আছে। কারণ ২০১৮ সালে সফটওয়্যার কেনা হলেও কেউ তো গাড়ির হিসাব দেয়নি। তাই নতুন সফটওয়্যার চালুর আগে সরকারের পুরনো গাড়িগুলো উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালাতে হবে।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি উদ্ধার করা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। এ জন্য জনপ্রশাসনসচিব কাজ করছেন। আশা করছি, বৈশ্বিক এ সংকট মোকাবেলার স্বার্থে গাড়িগুলো উদ্ধার করা যাবে এবং গাড়ির সঠিক হিসাবও পাওয়া যাবে। ’

সরকারি গাড়ির হিসাব সরকারই পাচ্ছে না, এর প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি জমা না দিলে প্রকল্প পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে পারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শাস্তি না দিলে গাড়ির অপব্যবহার রোধ করা যাবে না।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ