সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: কমিশনের সুপারিশের পর বছর পার হলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানার শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো। সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় খোদ মজুরি কমিশনই বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এদিকে বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন না হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। তারা কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন। অবশ্য সরকার বলছে, প্রতিবেদনটি বর্তমানে সচিব কমিটির পর্যালোচনায় রয়েছে। তাদের রিপোর্ট পেলেই এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর করার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত শিল্প শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো নির্ধারণের লক্ষ্যে জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১৫ গঠন করা হয়। সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেয়। কমিটি ১৯টি বৈঠকের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। পরে ওই বছর এপ্রিল মাসেই সুপারিশসহ নতুন মজুরি কাঠামো জমা দেয় কমিশন।
সুপারিশে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো গড়ে শতভাগ মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরির সুপারিশ করা হয় ৮ হাজার ৩০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬০০ টাকা। মজুরির পাশাপাশি খাতভিত্তিক ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশও করা হয়। সুপারিশে ঢাকা মহানগরীতে বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৬০ ভাগ এবং অন্যান্য স্থানে ৫৫ ভাগ করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া, সরকারি চাকরিজীবীদের মতো শ্রমিকদেরও মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে নববর্ষ ভাতার সুপারিশ করা হয়।
বিদ্যমান জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন ২০১০-এ রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানার শ্রমিকদের মজুরি সর্বোচ্চ মজুরি পাঁচ হাজার ৬০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন চার হাজার ১৫০ টাকা ধরে মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছিল।
গত বছর ৪ জুলাই ওই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে তা পর্যলোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে কমিশনের সুপারিশের বছর পার হলেও নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে শ্রমিকরা। তারা দফায় দফায় আল্টিমেটাম দেওয়ার পাশাপাশি কঠোর আন্দোলনের যাওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। গত ১২ অক্টোবর শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সুপারিশ বাস্তবায়নের সময় সীমা বেঁধে দেয়। এরই মধ্যে সংসদের প্রশ্নোত্তরে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে না হওয়ায় আবারও কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক সংগঠন। গত ২৭ এপ্রিল শ্রমিক সংগঠনগুলোর একটি প্রতিনিধি দল শ্রম ও কর্মসংস্থার প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর সঙ্গে সাক্ষাত করে দ্রুত মজুরি কাঠামোর সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, ওই বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী মে দিবসে এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণাসহ এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আমিনুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার বার বার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আমরা প্রতিবারিই নিরাশ হচ্ছি। গত ডিসেম্বর থেকে বাস্তবায়ন করার জন্য সংসদে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু হয়নি। শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের প্রতিনিধিরা গত ২৬ এপ্রিল সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি এক মাসের সময় নিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে না হলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে।’
২০১৫ সালের জুলাই থেকে সুপারিশ কার্যকরের দাবি করে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘জাতীয় বেতন স্কেলের মতো আমাদের মজুরি কাঠামোও ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে শ্রমিকরা তা মেনে নেবে না। দরকার দলে রাজপথ-রেলপথ অবরোধ করা হবে।’
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও মজুরি কমিশনে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি সদস্য ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিশন গঠন করার সময় আমাদের বলা হলো তাড়াতাড়ি প্রতিবেদন করতে। আমরা তাড়াহুড়া করে প্রতিবেদন দিলাম ঠিকই, কিন্তু সরকারের তা বাস্তবায়নে তাড়া দেখছি না। এটা খুবই দুঃখজনক।’
জাতীয় পে-স্কেল বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি কারখানার পিয়ন থেকে শুরু করে প্রশাসনিক শাখায় যারা রয়েছেন জাতীয় পে-স্কেল অনুযায়ী আরও তিন বছর আগেই তাদের বেতন বেড়েছে। অথচ ওই কারখানার উৎপাদন সেক্টরে যারা আছেন তাদের বেতন আগেরটাই রয়েছে। এটা চরম বৈষম্য। আমরা আশা করবো কোনও ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার আগে যেন সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যেই এটা বাস্তবায়ন করে। শ্রমিকদের প্রত্যাশা পূরণ করে।’
কমিশনের সুপারিশ যে এখনও বাস্তবায়ন হয়নি সেটা জানেন না জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১৫ এর চেয়ারম্যান সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খান। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের কমিশন তো মাত্র ৬ মাসের মধ্যে সুপারিশ প্রণয়ন করে সরকারকে দিয়েছে। আমার তো ধারণা ছিল এতদিনে এটা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। কিন্তু এটা যে এখনও বাস্তবায়ন হয়নি তা আমার জানা নেই। দেখি কেন দেরি হচ্ছে আমি নিজেই তার খোঁজ নেবো।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘কমিশনের সুপারিশটি বর্তমানে পর্যালোচনার জন্য সচিব কমিটিতে আছে। তাদের রিপোর্ট পেলেই আমরা এটা বাস্তবায়ন করে ফেলবা। আশা করছি দু‘একমাসের মধ্যেই এটা সম্ভব হবে।’
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রায়ত্ত অর্ধশতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন।
বাংলা ট্রিবিউন