সরকারি অর্থের সংস্থান ও ব্যবহার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

যেকোনো দেশের উন্নয়নেই সরকারের বিশেষ ভূমিকা পালনের প্রয়োজন হয়। এর জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। একটি দেশের অর্থ সাধারণত দুটি উৎস থেকে আসে। একটি হলো অভ্যন্তরীণ সম্পদ এবং অন্যটি বহির্বিশ্ব থেকে আসা সম্পদ।

অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রধান সংস্থানটা হলো সঞ্চয়। এই সঞ্চয় বলতে সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের সঞ্চয়কেই বোঝায়। বাইরে থেকে আসা সম্পদ বলতে সাধারণত ঋণ, অনুদান ও বিদেশি বিনিয়োগকে বোঝায়। একটি দেশের সম্পদের ঘাটতি (রিসোর্স গ্যাপ) বলতে সরকারের রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয়ের তুলনায় প্রয়োজনীয় অর্থের ঘাটতিকে বোঝায়। এই ঘাটতি পূরণ তথা অর্থের সংস্থান করাই একটি সরকারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের কাজ।

আমাদের দেশে এই মুহূর্তে সঞ্চয় বিনিয়োগের ঘাটতি (সেভিংস ইনভেস্টমেন্ট গ্যাপ) অনেক বেশি। অর্থাৎ আমাদের যতটুকু বিনিয়োগ প্রয়োজন, দেশীয় সঞ্চয় দিয়ে তা হয় না। হালনাগাদ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জিডিপি অনুপাতে আমাদের জাতীয় সঞ্চয় সাড়ে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের ৭ বা সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে এটা ৩২ শতাংশ হতে হবে। সুতরাং এখানে বড় একটি ঘাটতি আছে। এটাকে সেভিংস ইনভেস্টমেন্ট গ্যাপ বলা হয়ে থাকে। আমাদের আরেকটি ঘাটতি হলো আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি। আমাদের রপ্তানি সব সময় বেশি এবং আমদানি কম, যা বৈদেশিক মুদ্র্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

এই ঘাটতিগুলো কিভাবে পূরণ হয়? প্রথমত, দেশের সেভিং ইনভেস্টমেন্ট বা সঞ্চয় বিনিয়োগ থেকে পূরণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, সরকারের কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি এবং তৃতীয়ত, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করে তা পূরণ করা হয়। এর মধ্যে বৈদেশিক লেনদেনে যে ঘাটতি রয়েছে, তথা আমদানি-রপ্তানির যে ঘাটতি, সেটি পূরণ করতে হলে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। সাধারণত আমাদের যে বাণিজ্য ঘাটতি, সেটা পূরণ হয় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে। এর বাইরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ। সর্বশেষ হলো অনুদান ও ঋণ।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা মেটাতে গিয়ে অর্থের সংস্থান হিসেবে আমরা দেখি কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি নয়। বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন যে এটা আমাদের ১৪ শতাংশ করতে হবে। এমনকি আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অনুপাতই সবচেয়ে কম। এমনকি নেপালের মতো দেশেও কর-জিডিপির অনুপাত ১৪ শতাংশ। এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে তা আরো বেশি। এটা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে যে এনবিআরকে আরো সক্রিয় হতে হবে, করজাল আরো বিস্তৃত করতে হবে।

এখন দেশের যে নিজস্ব সঞ্চয় কমে যাচ্ছে, এর পেছনে অন্যতম কারণ ৯-৬ শতাংশ সুদের হার। আবার প্রকৃত অর্থে গড়ে এই সুদের পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি হয় না। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকের ডিপোজিটও কমে আসছে। এর কারণ হচ্ছে, অনেক মানুষ সঞ্চয় ভেঙে নিজেদের সংসার চালাচ্ছে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ। এটার ফলে আমাদের এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে।

আরেকটা ব্যাপার হলো সরকারের ঋণ গ্রহণের বিষয়টি। সম্প্রতি আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, সরকার কতটা দর-কষাকষি করতে পারে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যাপারটিকে আমি নেতিবাচকভাবে দেখছি না। তবে আমাদের সর্বোচ্চ দর-কষাকষি করতে হবে। আইএমএফ সাধারণত ব্যালান্স অব পেমেন্ট সহায়তা দেয়। দেখা যাচ্ছে, দেশে আমদানি-রপ্তানির বড় ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এটার প্রভাব পড়ছে আমাদের রিজার্ভের ওপর। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এই অবস্থায় আইএমএফের ঋণ নিতে গিয়ে বড় প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে তাদের শর্ত কী হতে পারে। তাদের শর্তগুলোর মধ্যে অনেক কঠিন শর্তও থাকবে। কিন্তু সুবিধা হলো, আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আইএমএফের সব কথাই যে মানতে হবে সেটা না, তা নির্ভর করছে দর-কষাকষির ওপর।

আইএমএফ অনেক সময় ভর্তুকি তুলে দেওয়ার শর্ত দিয়ে থাকে। যেমন—খাদ্য, কৃষি ও জ্বালানির ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহারের শর্ত থাকে। সেগুলো চ্যালেঞ্জ করতে হবে। ইউরোপের জায়গা থেকে আমাদের দেখলে চলবে না। আমাদের এসব ভর্তুকি তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। যদিও সম্প্রতি সারের দাম একটু বাড়িয়েছে প্রান্তিকভাবে। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধি যেন একা কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। বাইরের ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে আমরা নির্ভর করি বহুজাতিক দাতা সংস্থার কাছ থেকে—আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংক সাধারণত যা করে সেটা হলো বাজেট সহায়তা। বাজেট সহায়তা মানে আমাদের যে বাজেট ঘাটতি থাকে, সেটা ঋণ দিয়ে পূরণ করা। বিশ্বব্যাংক অবশ্য বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকেও ঋণ নেওয়ার চিন্তা করছে।

এখন আইএমএফের শর্তগুলো নিয়ে দর-কষাকষি করতে হবে। আইএমএফ আরো কয়েকটি সাধারণ শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমানো ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যৌক্তিক (রেশনালাইজ) করার কথা বলা থাকে। আমদানি-রপ্তানি এবং ট্যারিফ ও কাস্টমস ব্যবস্থা যৌক্তিক করাও তাদের শর্তের মধ্যে থাকে। এ ছাড়া বন্দর সুবিধা ও বাণিজ্য সহজীকরণের শর্ত থাকে। এই শর্তগুলো তো আমাদের নিজস্ব প্রয়োজনেই করা উচিত। এখন আইএমএফের সঙ্গে কথা বলে তাদের যুক্তিসংগত শর্তগুলো মেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে তাদের ঋণ আসুক বা না আসুক, আমাদের এই কাজগুলো করে ফেলা উচিত। এগুলো করতে পারলে বাইরে একটা বার্তা যাবে যে বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনছে এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

দ্বিপক্ষীয় সহায়তার ক্ষেত্রে ঋণের পাশাপাশি অনুদানও আসে। দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্রম অনুযায়ী আমাদের সবচেয়ে বেশি ঋণ রাশিয়ার। দ্বিতীয় চীন ও তৃতীয় ভারত। অবশ্য জাপান থেকেও একটা বৃহৎ অংশ আসে। রাশিয়ার ঋণটা হলো রূপপুর প্রকল্পের জন্য। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক নতুন রেলপথ নির্মাণ ও কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অনেক প্রকল্পে চীনের ঋণ রয়েছে। ভারতের ঋণগুলো হচ্ছে লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে। দ্বিপক্ষীয় উৎসর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ঋণ দেয় জাপান। জাপান সরকার অনেক ঋণই অনুদানে রূপান্তর করে থাকে।

তবে আমরা ইদানীং দেখছি যে মেগাপ্রকল্পের চাপে পড়ে আমরা যে ঋণগুলো নিয়ে আসছি, এই ঋণগুলো শোধ দেওয়া হবে দুই বছর পরে আংশিক এবং বাকিগুলো ২৫ বা ২৬ সালের দিকে শুরু হয়ে যাবে। তখন থেকে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। এই জিনিসটা খতিয়ে দেখতে হবে ভালো করে। দ্বিপক্ষীয় ঋণে সুদের হার সাধারণত বেশি হয় এবং দাতা দেশ থেকে কেনাকাটার কঠিন শর্ত থাকে। তৃতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় ঋণে গ্রেস পিরিয়ড কম থাকে।

এখন সময় এসেছে সরকারের অর্থের যে সংস্থান এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা। অর্থ সংস্থানে আমাদের তাত্ক্ষণিক বা আপৎকালীন নয়, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ঋণের বোঝা বাড়তে থাকবে; কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তা শোধ করতে পারব না—এটা হতে পারে না।

এই মুহূর্তে চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত, যেসব প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি কিংবা রাশিয়া বা চীন থেকে ঋণ নেব; তার প্রাধিকার নির্ণয় করা। কোনটা কতটুকু জরুরি, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আমরা জানি যে দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে অনেক লবি থাকে। এই লবি বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে তাদের ঋণটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই লবিকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঋণ ও অনুদান ব্যবহার ঠিকঠাকভাবে করা।

তৃতীয়ত, ঋণ শোধ দেওয়ার সক্ষমতাটা পুনর্মূল্যায়ন করা। ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা যাচাই করা এই মুহূর্তে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। একটা হিসাব করা দরকার যে কোন বছরে কত টাকা শোধ করতে হবে। সম্প্রতি আলোচনা হচ্ছে, আমাদের ঋণ শিডিউলটাকে সংশোধন করা নিয়ে যে কবে, কাকে কখন কত টাকা শোধ করতে হবে। কিন্তু আমার জানা মতে, যখনই নতুন কোনো ঋণ নিয়ে আলোচনা ও দর-কষাকষি করা হয়, তখনই আসল ও সুদ পরিশোধের একটা শিডিউল করা হয়। মানে ঋণের আসল শোধ করতে কত বছর এবং সুদ পরিশোধ করতে কত বছর লাগবে, এটাকে অ্যামোরটাইজেশন বলে। এটা কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখন অনেকে বলছেন যে এই অ্যামোরটাইজেশন সংশোধন করতে হবে। কারণ এটা ঠিক না করে ঋণ নিলে বড় ভুল হবে। আমিও মনে করি, প্রয়োজন হলে এটা সংশোধন করা উচিত।

চতুর্থটা হলো ঋণদাতাদের শর্তগুলো আরো ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। তারা যে শর্তগুলো দেয়, তা নিয়ে দর-কষাকষিতে আমাদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে যেসব আমলা দর-কষাকষির দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা প্রায় ক্ষেত্রেই রুটিনকাজ সারেন। তাঁদের মধ্যে অনেক সময় আন্তরিকতারও ঘাটতি থাকে। অনেক সময়ই দেশের পক্ষে মরিয়া ভাবটা তাঁদের মধ্যে দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যানেরও ঘাটতি দেখা যায়। কর্মকর্তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকলে দর-কষাকষিতে সুবিধা হয়।

সুতরাং সার্বিকভাবে আমি বলব যে সরকারের অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎসর পাশাপাশি বহির্বিশ্বের উৎসরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সরকারের কাজ হলো, বিদেশি উৎসর প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা এবং যথাযথ উপায়ে তা আনা ও সুষ্ঠু ব্যবহার করা। এর মধ্য দিয়ে আমরা টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারব।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

 

সুত্রঃ কালের কন্ঠ