সব চিটারের দলের সর্দার আমি : রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি

জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানা। ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

‘আমার চোখ চারদিকেই থাকে। এসব চিটারি করতে পারবা না। বহুত বড় চিটারি-বাটপারি কইরি (করে) আমি প্রেডিডেন্ট হইছি (হয়েছি)…। সব চিটারের দলের সর্দার আমি।’ এভাবেই নিজেকে ছাত্রলীগের এক নারী কর্মীকে মোবাইল ফোনে উপস্থাপন করেন রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রান। গত বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাতে ওই নারী কর্মীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথোপকথনের কল রেকর্ডটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ৪ মিনিট ১০ সেকেন্ডের ওই অডিওটি ভাইরাল হলে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতিকে নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়।

অভিযোগ রয়েছে, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রানা এক সময় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন। পরে রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নরত থাকাকালীন ২০১৬ সালে রানা কলেজটির মুসলিম হল শাখা ছাত্রদলের ৬ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এই কমিটি বিলুপ্তির দুই বছর পরই তিনি হয়ে যান রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। ‘বিতর্কিত’ এই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে নারীর সঙ্গে অশ্নীল ভিডিও, অনৈতিক প্রস্তাব, রাতের আঁধারে রাজশাহী শহরে মদ খেয়ে মাতলামি করে নগরবাসীর হাতে গণপিটুনি খাওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রদলের হল কমিটিতে স্থান পেয়েছিলেন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রানা

অভিযোগ রয়েছে, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার আগে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষ পদের এক নেতার বাড়ির বাজার করা, ফরমায়েশ খাটাসহ ছোটখাটো সব কাজই করে দিতেন সাকিবুল ইসলাম রানা। এ কারণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ওই নেতার মা-বাবার স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন রানা। বাবা-মায়ের আবদারের কারণেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ওই নেতা এক সময়কার ছাত্রদলের নেতা রানাকে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির আসনে বসিয়ে দেন।

অভিযোগ শুধু যে রানার বিরুদ্ধেই বিষয়টি তা নয়; জেলা ছাত্রলীগের ৩০ সদস্যের আংশিক এই কমিটির অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ। নিজ দলের কর্মীকে ধরে এনে নির্যাতন, দলের মেয়েদের রুমে নিয়ে এসে স্ফূর্তি করাসহ নানা অভিযোগে জর্জরিত গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্র ঘোষিত আংশিক এই কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা।

রানার ছাত্রদল জীবনের গল্প:

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাসের ৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেন কলেজ ছাত্রদল সভাপতি মুর্ত্তজা ফামিন ও সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মাকসুদুর রহমান সৌরভ। এই কমিটির ৬ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন সাকিবুল ইসলাম রানা। টানা তিন বছর এই কমিটির সক্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। তবে ২০১৯ সালের দিকে ছাত্রদলের কমিটিতে থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকায় গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা হওয়ার জন্য তদবির শুরু করেন। ছাত্রদল করার আগে শিবির করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বিএনপির নেতা মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে বর্তমান ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি রানা। পুরনো ছবি

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে ছাত্রদল নেতাদের একটি ছবিতেও দেখা যায় তাঁর পাশেই রয়েছেন রানা। রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মুর্ত্তজা ফামিন বলেন, রানা রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের নেতা। কলেজের মুসলিম হল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। আমাদের সঙ্গে ছাত্রদলের মিছিল-মিটিং করতেন। ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সারাদেশের কলেজ ও হল কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার আগেই লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, রানা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছেন। অথচ হল শাখার নেতা হিসেবে ছাত্রদলের অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন তিনি।

রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রকি কুমার ঘোষ বলেন,‘ সাকিবুল ইসলাম রানা আগে শিবির, পরে ছাত্রদল করত। সক্রিয় নেতা হিসেবে মিছিল-মিটিং করত। তার বিরুদ্ধে একবার সাইকেল চুরির অভিযোগও উঠেছিল নগরীর দরগাপাড়ায়। এসব অভিযোগের কারণে তাকে মুসলিম হল থেকে বের করে দিয়েছিলাম। এখন সেই রানাই জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি।’

ছাত্রদলের কমিটিতে থাকা এবং মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে ছবিতে থাকার বিষয়ে  জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রানা বলেন, ‘আমার ছবি এবং নাম এডিট করে কেটে লাগিয়েছে। এটা ষড়যন্ত্র। ছবি দেখেন, গলাকাটা। কমিটির লিস্টে দেখেন- আমাকে ৬ নম্বরের পরে লাগাইছে।’ অশ্নীল ভিডিও ভাইরালের বিষয়ে বলেন, ‘সেটা আমি না। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার।’

মদ্যপ অবস্থায় মাতলামি :
চলতি বছরের ২৫ আগস্ট রাত আড়াইটায় নগরীর ঘোষপাড়ায় অস্ত্র হাতে মদ্যপ অবস্থায় মাতলামি করছিলেন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানা ও যুগ্ম সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম শান্ত। এলাকাবাসী তাঁদের থামাতে গেলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। পরে রানা, শান্তসহ তাঁদের সহযোগীদের পিটুনি দেন স্থানীয়রা। এ সময় তাঁরা নিজেদের দুটি মোটরসাইকেল ফেলে পালালে তা ভাঙচুর করেন স্থানীয়রা। পরে বোয়ালিয়া থানা পুলিশ বাইক দুটি জব্দ করে।

রানার ভিডিও ও অডিও ভাইরাল:

সম্প্রতি এক হিন্দু নারীর সঙ্গে রানার অশ্নীল কাজের ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে হাতে শাঁখা পরা ওই নারীকে ওইভাবে চেনা না গেলেও জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রানাকে পরিস্কার দেখা গেছে। এছাড়াও গত বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে রানার আরেকটি অডিও ফাঁস হয়। চার মিনিট ১০ সেকেন্ডের ওই অডিওতে জেলা ছাত্রলীগের এক নারী নেত্রীকে বিছানায় আসার এবং আরেক নারীকে পাঠাতে বলেন রানা।

 

ফাঁস হওয়া অডিওটির কথোপকথন সিল্কসিটির পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:


ছাত্রলীগ নেত্রী : ‘হ্যালো, আচ্ছাসালামু আলাইমুক’। ছাত্রলীগ সভাপতি : ‘তুমি আমার সাথে নাটক করিচ্ছো (করতেছো) তাই না?’  ছাত্রলীগ নেত্রী :  ‘কিসের নাটক ভাইয়া?’  ছাত্রলীগ সভাপতি : ‘তোমার কথা-কাজে মিল পাচ্ছি না। চিটারি করতে পারবা না। বহুত বড় চিটারি-বাটপারি কইরি (করে) আমি প্রেসিডেন্ট হইছি (হয়েছি)। সব চিটারের দলের সর্দার আমি। তুমি না হয়, আসতে চায়া (চেয়ে) আসলে না, কাকে যে পাঠাতে চাইলে সে কই? একজনের সাথে কইরি (ফিজিক্যাল রিলেশন) তুমি যদি বড় নেত্রী হও, সেটা মানুষ মাইনি (মেনে) লিতে (নিতে) পারে না, তুমি বুঝ না?’  ছাত্রলীগ নেত্রী : ‘এগুলো তো ভাইয়া অবান্তর কথা, আর আমার ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দরকার নাই। আমি যথেষ্ট ভালো আছি। সংগঠনটাকে ভালোবেসেই আসছিলাম।’  ছাত্রলীগ সভাপতি : ‘তাহলে শোন ঠিক আছে আর শান্ত-মান্তর কোনো বেল নাই।’  ছাত্রলীগ নেত্রী : ‘তো ভাইয়া আপনি মেয়ের কথা কালকে বলছিলেন, তো আমি ছবি পাঠাইছিলাম।’ ছাত্রলীগ সভাপতি : ‘দেখো দেখো পাঠাতে পারো নাকি?’ ছাত্রলীগ নেত্রী : ‘উনিও তো ফ্যামিলির সঙ্গে থাকেন।’ ছাত্রলীগ সভাপতি: ‘এখন রাত আটটা বাজে। কী এমন রাত? দেখ দেখ ফোন দাও। পাঠাও। কেউ যেন না জানে।’ ছাত্রলীগ নেত্রী : ‘ না, না কে জানবে? আপনি আমাকে ভরসা করতে পারেন।’ ছাত্রলীগ সভাপতি : ‘খুব ভরসা করি, প্রতিরাত ভরসা করি, তুমি জানো না? ছাত্রলীগ নেত্রী : ‘জি ভাইয়া’। ছাত্রলীগ সভাপতি : দেখো দেখো, দ্রুত দেখো’। ছাত্রলীগ নেত্রী : তো, ওদেরকে পাঠালে তো আল্লাহ জানবে…!

অডিও-ভিডিও ভাইরালের বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমাদের ভেতরের কেউই ষড়যন্ত্র করছে। সংগঠনে নেতাকর্মী বাড়াতে কাউকে উৎসাহ দিতেই পারি, তাই না? খারাপ কিছু তো বলিনি।’ ভিডিও ফাঁসের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব ষড়যন্ত্র। আমাকে ফাঁসাতে ফটোশপের মাধ্যমে এসব করা হয়েছে।’

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রানার বিরুদ্ধেই যে এসব অভিযোগ তা নয়। মাদক সেবন ও নিজ দরের কর্মীদের মারপিটের রয়েছে জেলার সাধারণ সম্পাদকের জাকির হোসেন অমির বিরুদ্ধেও। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের এই শিক্ষার্থী নিজের হোস্টেলকেই বেছে নিয়েছেন মাদক সেবনের আখড়া হিসেবে। সম্প্রতি অমির ফেনসিডিল সেবনের একটি ভিডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে।

শুধু তাই নয়, তিনি প্রায়ই নিজ দলের কর্মীদের ধরে মারধর ও নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিমানবন্দরে প্রকাশ্যে আমিনুল ইসলাম সবুজ নামের ছাত্রলীগের এক কর্মীকে পেটান অমি। জানা গেছে, ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁকে মারধর করেন তিনি।

জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রানা ও সাধারণ সম্পাদক অমি (ডানে)। ফাইল ছবি

বাগমারা উপজেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বপ্রত্যাশী সবুজ বলেন, বাগমারার এমপি এনামুল হককে রিসিভ করতে রাজশাহী বিমানবন্দরে গেলে আমাকে মারধর করেন অমি। এতে কানে ও নাকে মুখে প্রচণ্ড আঘাত পাই। এর আগে গত ২৬ জুলাই রাজশাহী মেডিকেলের নুরুন্নবী হোস্টেলে এনে মিলন হোসেন নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন করেন অমি। মিলনকে অমির পিএ বানানোর কথা বলে পুঠিয়ার শিবপুর থেকে আনা হয়েছিল। পরে মাদক সেবনসহ খারাপ পরিবেশ দেখে মিলন কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপরই নির্যাতন শুরু হয়। এ ঘটনায় মিলনের বাবা আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে পুঠিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন অমির বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমি বলেন,  ‘সবুজ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল। তাই একটি থাপ্পড় দিয়ে শাসন করেছিলাম। ফেনসিডিল খাওয়ার বিষয়টি কখনোই সত্য নয়। কেউ ভিডিও দেখালে সেটা এডিট করা বলে ধরে নেবেন। মিলন হোস্টেলে চুরি করেছিল। আমি তাকে উদ্ধার করেছি। আমার প্রতিপক্ষ অপপ্রচার করেছে।’

এএইচ/এস