সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সমাজ কিংবা একটি দেশ সব ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সমন্বয় ছাড়া শান্তি-সমৃদ্ধি এবং সম্প্রীতির পথে এগোতে পারে না। কারণ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে পুরুষের সমান আবার কোথাও কোথাও একটু বেশি সংখ্যকই রয়েছেন নারী। কাজেই এ বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ, সমন্বয়, সহযোগিতা ছাড়া পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, এমনকি দেশ সঠিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন,… ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। … এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাহে রূপ-রস-সুধা-গন্ধ সুনির্মল, সেদিন সুদূর নয়-যে দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়..।’
সম্ভবত, নারীদের জন্য কবি নজরুলের সেই প্রত্যাশিত শুভদিন এখন। সমাজের উন্নয়নে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা দরকার। একটা সমাজ গড়ে তুলতে চাইলে সবাইকে সুযোগটা করে দিতে হবে।’
নারীরা এখন শুধু রেঁধে কিংবা চুল বেঁধেই তাদের দিন অতিবাহিত করেন না। এখন তারা সবখানেই নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন নিজ নিজ যোগ্যতা, মেধা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। আমাদের দেশের নারীদের সরব অবস্থান এখন কেবল পরিবারেই সীমাবদ্ধ নেই, সমাজের বিভিন্ন স্তর-প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার, ভিডিপি, বিজিবি, বিমান পরিচালনা, ট্রেন পরিচালনা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, শিক্ষকতা, নার্সিং, রাজনীতি- সর্বত্র নারীর বিচরণ রয়েছে।
এটা নির্দ্বিধায় বলার সময় এসেছে যে, নারীরা তাদের এ অধিকার আদায় করে নিচ্ছেন নিজ মেধা, যোগ্যতা আর দক্ষতাগুণে। জাতীয় সংসদের স্পিকার থেকে শুরু করে তৃণমূলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- সব স্তরেই নারী তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছে ও রাখছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, প্রতিশ্রুতি আর সমান অধিকারের নীতির ফলেই দেশের সর্বত্র নারীদের এখন চলছে জয়জয়কার। বিভিন্ন সংস্থার জরিপেও অর্থনীতিতে নারীর অবদানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হচ্ছে।
শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, শিক্ষাবঞ্চিত- সব স্তরের নারীই কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতিতে নিরবচ্ছিন্ন অবদান রাখছেন। সরকারি সংস্থা বিডিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, জিডিপিতে কর্মজীবী নারীদের অবদান ২০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী অর্থনীতির সূচকের তিন খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে কাজ করছেন। অর্থনীতিতে নারীর সাফল্য বেড়েছে, নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে উৎপাদন ব্যবস্থায়।
সমীক্ষা অনুযায়ী, মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। এখাতে ৫০ লাখ ১৫ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করেন। তাদের মধ্যে নারী ২২ লাখ ১৭ হাজার। তবে নারী কর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী। বাকিদের মধ্যে কেউ উদ্যোক্তা কেউ চিকিৎসক বা প্রকৌশলী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ নির্বাহী এবং উচ্চপদেও দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা।
শ্রমবাজার নিয়ে বিবিএসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ নারী কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৬৮ লাখে। প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ নারী কর্মে যুক্ত হচ্ছেন।
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে কৃষি খাতে নিয়োজিত আছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। এছাড়া শিল্প ও সেবা খাতে কাজ করেন যথাক্রমে ৪০ লাখ ৯০ হাজার এবং ৩৭ লাখ নারী। দেশের কলকারখানায় পুরুষের চেয়ে বর্তমানে এক লাখ বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন।
গত এক যুগে বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর সম্পৃক্ততা বেড়েছে প্রশংসনীয়ভাবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মতোই দেশের কৃষি খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন নারীরা। বিবিএসের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। আর পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে দুই শতাংশ।
চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা ও তামাকশিল্পসহ অন্যান্য পণ্যের মোট রফতানি আয়ের ৭৫ ভাগ অর্জনের মূল চালিকাশক্তিই নারী। পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৮০ ভাগই নারী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছে, অর্থনীতিতে বিশেষ করে চাকরি ও ব্যবসায় নারীর সংখ্যা অতিদ্রুত বাড়ছে।
শ্রমশক্তিতে ১৯৯৫-৯৬ সালে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৫.৮ শতাংশ, বর্তমানে তা বেড়ে ৩৬.৩ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত দেখিয়েছেন, গৃহস্থালি কাজে সারা দেশের নারীরা বছরে ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন, যার আর্থিক মূল্যমান দুই লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। জিডিপিতে এ আর্থিক মূল্য যোগ হলে নারীর হিস্যা বর্তমানের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশে।
প্রশাসনে বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণ লক্ষণীয়। বিচারপতি, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সব ক্ষেত্রেই নারী তার বিচক্ষণতা, দক্ষতা এবং সুনামের সঙ্গে পালন করছেন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব।
দেশ পরিচালনায় মাঠ প্রশাসনে নিষ্ঠা, দক্ষতা আর যোগ্যতার সঙ্গে নিরলসভাবে সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে চালিয়ে আসছেন নারী। উপজেলা প্রশাসনের সব বিভাগের সার্বিক কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় ও দায়িত্ব তদারকি উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত নারী কর্মকর্তারা।
পাশাপাশি এসব নারী কর্মকর্তা তাদের নিজ নিজ উপজেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের তদারকি ও বাস্তবায়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতি ও পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও সফলভাবে ভূমিকা রাখছেন। এসবের পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রেও দেশের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক সমস্যা দূরীকরণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে ও সঙ্গে নিয়ে কাজ করে চলেছেন নারীরা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয় (সরকারি-বেসরকারি), কিন্ডারগার্টেনসহ মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষ শিক্ষকের চেয়ে নারী শিক্ষক অনেক বেশি। অনুরূপ চিকিৎসা ক্ষেত্রে, নার্সিং পেশায় বহু নারী দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আর এভাবেই সব ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নে নারী রাখছে দক্ষতা ও মেধার স্বাক্ষর।